রাজনীতি

সাতক্ষীরা-৪, আওয়ামী লীগে একাধিক প্রার্থী, চতুর্মুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

  সাতক্ষীরা প্রতিনিধিঃ ২১ এপ্রিল ২০২৩ , ৪:৪৫:১১ প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় সংসদের ১০৮ নম্বর আসনটি নিয়ে গঠিত সুন্দরবনঘেরা সাতক্ষীরা-৪ আসন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সাতক্ষীরা-৪ আসনটির ১২টি ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কালিগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়ন। মোট ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ আসনে আবারও বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচন নিয়ে এখনো দোটানায় বিএনপি।
তবে এবার আসনটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন মুখ আশা করছে স্থানীয় একাংশের নেতাকর্মীরা। গত পাঁচ বছরে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাজের মূল্যায়ন ও দলীয় নেতাকর্মীদের কাজের মূল্যায়নে এবার দলীয় মনোনয়নে তরুণ নতুন মুখ আসতে পারে- এমনটিও নির্বাচনী এলাকায় প্রচার রয়েছে। এ ছাড়া জামায়াত ও বিএনপির রিজার্ভ ভোট মোকাবিলা করতে এই অংশের নেতাকর্মীরা প্রার্থী নির্বাচনে নতুনত্ব দেখতে চান।

তবে এই আসনের বর্তমান এমপির অনুসারী নেতাকর্মীরা দৃঢ় কণ্ঠেই বলছেন, বর্তমান এমপিই জনপ্রিয়তা দিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগকে এই আসনটি উপহার দিতে পারবেন। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সাতক্ষীরার অধিকাংশ এমপি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের খোঁজ রাখেন না। মূলত দলীয় গ্রুপিং, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন মতবিরোধের কারণে নেতাকর্মীরা বিভক্ত।

যার প্রভাব পড়েছে বিগত সাতক্ষীরা পৌরসভা ও জেলার সাতটি উপজেলার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। জেলার মূল দলসহ সহযোগী সংগঠনগুলো বিভক্ত, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যেও রয়েছে দূরত্ব। সবাই ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া। এ কারণে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের ভিত অনেকাংশে দুর্বল, এমনটি মনে করেন সাধারণ কর্মী ও সমর্থকরা।

এসব নেতাকমীর অভিযোগ হচ্ছে, বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে মাঠের ত্যাগী নেতাকর্মীদের তেমন মূল্যায়ন না হওয়ায় নেতাদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের দূরত্ব বাড়ছে। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করেন, টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আগের চেয়ে তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে এখন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তা ছাড়া দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আর এই সমস্যার সমাধান  পরিবর্তিত নেতৃত্বের মাধ্যমেই সম্ভব বলে এলাকার তরুণ সমাজ মনে করে।
জেলার শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৪  আসনে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা চার লাখেরও বেশি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি (জাপা) ও জামায়াতের একাধিক প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে কালিগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়নকে শ্যামনগর উপজেলার সঙ্গে যুক্ত করার পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বর্তমানে টানা দুই মেয়াদে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম জগলুল হায়দার। জগলুল হায়দার ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেন তিনি।
দু’বারের এই সংসদ সদস্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে পুনরায় দলের মনোনয়ন পাবেন এমনটি আশা করে গণমাধ্যমকে বলেন, সাতক্ষীরা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই। প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, কিন্তু এখানে কোনো প্রতিহিংসা নেই। মানবিক কাজের জন্য তিনি দেশজুড়ে পরিচিত এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের উন্নয়নে সুন্দরবনঘেঁষা এই আসনের সাধারণ মানুষ খুশি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলেও তিনি বিজয়ী হবেন এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, এরপরও দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার জন্য তিনি কাজ করবেন।
তবে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অনেক তরুণ প্রার্থী এই আসন থেকে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন। সংসদ সদস্য জগলুল হায়দারসহ এ আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট কয়েক জন প্রার্থী রয়েছেন যারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে এবার দলীয় মনোনয়ন পেতে নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগসহ তৃণমূল  নেতাকর্মীদের সঙ্গে  মতবিনিময় করে চলেছেন।
এদের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য শেখ মাসুদা খানম মেধা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন। পেশায় একজন ব্যাংকার হিসেবে এবং এলাকার পুত্রবধূ হিসেবে তিনি এলাকায় পরিচিত। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ফরম জমা দেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় থেকে বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে  মাঠে রয়েছেন। আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি সাতক্ষীরা-৪ আসন শ্যামনগর এলাকা থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন।

শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউল হক দোলন এবারে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সমন্বয়হীনতা আসন্ন নির্বাচনে দলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে তিনি মনে করেন। দলে নেতাদের সঙ্গে সরাসরি বিরোধ বা কোন্দল না থাকলেও মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-কে ম্লান করছে, এমনটি মনে করেন এই তরুণ নেতা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার হয়ে কাজ করবেন বলেও জানান তিনি।
বিএনপি এখন নির্বাচন নয়, রাজপথে আন্দোলন নিয়ে ভাবছে, এমন মন্তব্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের। বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবি, গণতান্ত্রিক দলের নির্বাচনের প্রস্তুতি সব সময়ই থাকে। দলের নির্বাচন করার মতো অসংখ্য যোগ্য নেতা আছে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা হলে বিএনপি যাকে এই আসনে মনোনয়ন দেবে সেই বিজয়ী হবে। তবে একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির সিনিয়র নেতারা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না বলে ব্যাপক প্রচার চালালেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখছে দলটি। এ জন্য ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতিও জোরদার করছে।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন ছাড়া এর পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে বিএনপি কখনো এই আসন থেকে নির্বাচিত হতে পারেনি। তবে এবারের নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক এমপি (২০০১ সালের নির্বাচনে জোটের শরিক জাতীয় পার্টির এমপি) কাজী আলাউদ্দিন। এ ছাড়া সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাতক্ষীরা আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাড. সৈয়দ ইফতেখার আলী দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। তবে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। এ কারণে সরাসরি বিএনপির নেতাকর্মীদের নির্বাচনী কর্মকা- চোখে পড়েনি।
সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির গোলাম রেজা নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এরপর দুইবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এ আসন ফিরে পায়নি জাতীয় পার্টি। তবে এই আসনে জাতীয় পার্টির যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের প্রভাব থাকায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চতুর্মুখী হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
অপরদিকে মহাজোট থেকে দলীয় মনোনয়ন পেতে এই আসনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সাবেক এমপি ও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা এ এইচ এম গোলাম রেজা। এ আসনে জাতীয় পার্টির হয়ে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন কালিগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমানসহ আরও কয়েক জন। এই আসনে জাসদের প্রার্থী হিসেবে সাবেক অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহী দলীয়ভাবে নির্বাচন করবেন বলে জেলা জাসদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে দু’বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য জামায়াতে ইসলামীর গাজী নজরুল ইসলাম এবারও এই আসনের প্রার্থী, এমনটি ঘোষণা দলটির। তিনি ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সাতক্ষীরা-৫ আসনের শ্যামনগর উপজেলাকে কালিগঞ্জ উপজেলার আটটি ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করে সাতক্ষীরা-৪ আসনে বিন্যস্ত করে নির্বাচন কমিশন। এরপর অনুষ্ঠিত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয় পেলেও এ আসনে জয় পায়নি জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলামের নাম ঘোষণা করেছে। গাজী নজরুল ইসলাম জামায়াতের জেলা কর্মপরিষদ সদস্য ও শ্যামনগর উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির।  সাতক্ষীরা-৫ আসনকে সাতক্ষীরা-৪ আসনে বিন্যস্ত করার পরে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে পরাজিত হন।
জানা গেছে, দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১২০টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। সে তালিকায় রয়েছে সাতক্ষীরার চারটি আসনের মধ্যে তিনটি আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থীর নাম। একটি আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা না করলেও গোপনে জেলার চারটি আসনেই নিজেদের নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। এছাড়া নতুন দল হিসেবে বাংলাদেশ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাড.মোঃ শফিকুল ইসলামও তার দল থেকে নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।

আরও খবর: রাজনীতি