জাতীয়

ভেস্তে যাচ্ছে ইসির ইভিএম ভাবনা

  প্রতিনিধি ১১ জানুয়ারি ২০২৩ , ৩:৫৯:৫৩ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডেঃ

সামনের জাতীয় সংসদের ভোটে বড় পরিসরে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারা ৩০০ সংসদীয় আসনের ১৫০টিতেই ইভিএমে ভোট নিতে চেয়েছিল। বর্তমান বাস্তবতায় একসঙ্গে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের কারিগরি সক্ষমতা ইসির নেই। ফলে এ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি করে ইসি। সেই প্রস্তাব আগামী মঙ্গলবারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উঠছে না।

ইসি আগেই জানিয়েছিল, মধ্য জানুয়ারির মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন না হলে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে ইভিএমের পরিধি বাড়ানোর সেই ভাবনা থেকে ইসিকে সরে যেতেই হচ্ছে। শেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ছয়টিতে ইভিএমে ভোট হয়। ওই নির্বাচনে সার্বিক ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। এর বিপরীতে ইভিএমের ছয়টি আসনে ভোটের হার ছিল ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ।

ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বর্তমানে হাতে থাকা ইভিএম দিয়ে সর্বোচ্চ ৬০ আসনে ভোট নেওয়া সম্ভব। সবশেষ ২২ ডিসেম্বর পটুয়াখালীতে এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য ইভিএম কিনতে সরকারের কাছে আর্থিক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ আসনে ইভিএমে নির্বাচনের সক্ষমতা ইসির রয়েছে। বরাদ্দ পেলে নতুন মেশিন কিনে আগামী সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএমে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করছে কমিশন।

এদিকে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী একনেক বৈঠকে অনুমোদনের জন্য আটটি প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে। একনেকে উপস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের তৈরি করা প্রকল্প তালিকা সমকালের হাতে রয়েছে। এ তালিকায় ‘নির্বাচন ব্যবস্থায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এ ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পটির নাম নেই। অর্থাৎ আগামী মঙ্গলবার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের আর কোনো সুযোগ নেই। তবে ইসির তরফ থেকে পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাব গত রোববার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। জানতে চাইলে ওই বিভাগের সদস্য এবং সরকারের সচিব মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম গতকাল জানান, ইসির ডিপিপির ওপর পরিকল্পনা কমিশনের কিছু সুপারিশ ও পরামর্শ ছিল। এর আলোকে ইসির কাছ থেকে আরডিপিপি পেয়েছেন তাঁরা। এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলতে চাননি তিনি।

কবে নাগাদ প্রকল্পটি একনেকে যেতে পারে, সে বিষয়টিও এখন অনিশ্চিত। কারণ, করোনার পর থেকে দুই বছর ধরে একনেক বৈঠক বসছে অনিয়মিত। সবশেষ গত ২২ নভেম্বর একনেক বৈঠকটি হয়। অর্থাৎ দেড় মাসের বেশি সময় পর আগামী মঙ্গলবার একনেক বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। অনিয়মিত এ বিরতিতে চলতে থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে একনেক বৈঠক হওয়ার কথা নয়। পরবর্তী বৈঠক হতে পারে মার্চের প্রথম দিকে।

এমন বাস্তবতায় সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা থেকে সরে আসারও ইঙ্গিত দিয়েছে ইসি। প্রকল্পটির অগ্রগতি না থাকার কথা স্বীকার করে গত রোববার নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, প্রকল্পের অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল। মধ্য জানুয়ারির আগে প্রকল্পটি অনুমোদন না হলে নতুন মেশিন কেনা সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে ইসির হাতে থাকা ইভিএম দিয়েই ভোট গ্রহণ করা হবে। বাকি আসনগুলোতে সাধারণ ব্যালটেই ভোট হবে। গতকাল মঙ্গলবার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের এক বক্তব্যেও ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ সম্ভব না হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ডের সঙ্গে বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নির্বাচন হতেই হবে- ইভিএমে হোক আর ব্যালটে। তবে এ মুহূর্তে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে ইভিএম করা যেটা বাজেটে কুলাচ্ছে না- সেটা নিশ্চয়ই ইসি বুঝবে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ইভিএম ক্রয়সংক্রান্ত ইসির প্রস্তাবিত প্রকল্পের ওপর মূল্যায়নে বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে কমিশনের সংশ্নিষ্ট আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ। প্রয়োজনীয় খরচের জোগান দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মত কিনা, এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের সুস্পষ্ট মতামত চাওয়া হয়েছে। ইসির পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাবে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচন-সংশ্নিষ্ট খাতের খরচ ঠিক রেখে অন্য ব্যয় কমানোর কথা বলা হয়। এ ছাড়া প্রশাসনিক ব্যয়, সেবা, সম্মানী এমনকি ভূমি অধিগ্রহণ- এ রকম খাতগুলোর প্রস্তাবিত ব্যয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের তরফ থেকে। তবে শেষ পর্যন্ত এই অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পটি তালিকাভুক্ত করা হয়। ডিপিপির ওপর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের প্রোগ্রামিং কমিটির একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সুপারিশের ভিত্তিতে পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদনের পর নতুন এডিপিতে প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই অর্থবছরের অনুমোদিত এডিপির তালিকায় প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

ইভিএম প্রকল্পের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবীব খান বলেন, বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর পাঁচ শতাধিক নির্বাচন ইভিএমে হয়েছে। সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি। সর্বোচ্চ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার ব্যাপারে কমিশনের সিদ্ধান্ত ছিল। তাঁর নিজের ইচ্ছা, শতভাগ কেন্দ্রে ইভিএমের ব্যবস্থা করা। এখন পর্যন্ত ইসি অনড় ইভিএমে ভোটের ব্যাপারে। আর্থিক বিষয় বিবেচনা করে পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন জানানোর পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আগামী বছরের শেষ কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। নির্বাচনের আগে ইভিএম হাতে পেতে গত নভেম্বরেই প্রকল্পের কাজ শুরুর পরিকল্পনা ছিল ইসির।
নির্বাচনে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ইভিএম সেট ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার সেট ইসির কাছে রয়েছে। নতুন কিনতে হবে ২ লাখ ইভিএম সেট। ইভিএম সংগ্রহসহ অন্য খরচ মিলে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করা হয়।
ইসির প্রস্তাবে প্রতিটি সেটের মূল্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। কমিশনের হাতে থাকা বর্তমানের প্রতিটি ইভিএম সেট কেনা হয়েছিল ২ লাখ ৫ হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতিটি মেশিনে ১ লাখ টাকা করে বেশি দাম ধরা হয়েছে। ইভিএম কিনতে মোট ৬ হাজার ৬৬০ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবে চারটি জিপ গাড়ি এবং ৫৩৪টি ডাবল কেবিন পিকআপ কেনার কথা বলা হয়। এই খাতে খরচ ধরা হয় ২৬২ কোটি টাকা। আর জমিসহ ১০টি ওয়্যারহাউস করতে খরচ ধরা হয় প্রায় ৭৭ কোটি টাকা। অন্যান্য সব সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে অনেক বেশি খরচ ধরা হয়েছে। এসব বিষয়েই আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক: বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রায় সবাই ইভিএমের বিরুদ্ধে থাকলেও ইসি তাদের অবস্থানে অনড়। বিরোধী দলের নেতারা মনে করেন, এই মেশিনে কারচুপি বা ফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব। বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ করেছে। সংলাপে অধিকাংশ ব্যক্তিই বিতর্ক থাকায় ইভিএমে ভোট না নেওয়ার পরামর্শ দেন। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং নির্বাচন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোও ইভিএমের কারিগরি ত্রুটির কথা বলে আসছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ব্যবহূত ইভিএমে ভোটার ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। এ ব্যবস্থায় একজন ভোট দেওয়ার পর একটা প্রিন্ট করা স্লিপ বেরিয়ে আসবে। এতে ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখতে পারবেন। কোনো কারণে ভোট পুনর্গণনার প্রয়োজন হলে সেটা সহায়ক হবে। ভারতে এই ব্যবস্থা চালু আছে।

ইভিএম ব্যবহারে জটিলতা: এর আগের বিভিন্ন নির্বাচনে দেখা গেছে ইভিএমের কিছু দুর্বল দিক। সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট নেওয়া কেন্দ্রগুলোয় ভোট গ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ তুলেছেন জাতীয় পার্টির বিজয়ী মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। ইভিএমের একটি বড় সমস্যা ছিল বয়স্ক, বিশেষ করে নারী ভোটারদের আঙুলের ছাপ মিলছিল না।

জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন ভোটে ইভিএম ব্যবহারে ভোটারদের অনভ্যস্ততার কারণেও ধীরগতির সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ইভিএমে ভোটারের পছন্দমতো প্রতীকে ভোট দিতে না পারার অভিযোগও ছিল। অধিকাংশ অভিযোগ ছিল, গোপন কক্ষে আগে থেকেই সরকারি দলের লোকজন অবস্থান নিয়ে থাকা। ভোটার নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে ব্যালট ওপেন করার পর গোপন কক্ষে থাকা ব্যক্তি আগেই বাটন চেপে দিয়েছেন। সূত্র সমকাল

আরও খবর

Sponsered content