জাতীয়

অনেকের ফাঁসির দড়ি খুলে দিচ্ছে উচ্চ আদালত

  প্রতিনিধি ২৮ অক্টোবর ২০২২ , ৫:১০:৪৫ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ  টুডেঃ

সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় নিম্ন আদালত যার সামনে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন ফাঁসির দড়ি, উচ্চ আদালতে বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছেন সেই আসামি। অনেকের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মেয়াদে জেল। একটি-দুটি নয়, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া মামলার তিন ভাগের দুই ভাগেরই রায় পরিবর্তন হচ্ছে উচ্চ আদালতে। সুপ্রিম কোর্টের বিগত দুটি অবকাশে নিষ্পত্তি হওয়া ডেথ রেফারেন্সের ওপর চালানো অনুসন্ধানে এমনই চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিগত প্রায় দেড় মাসে ২৯টি ডেথ রেফারেন্স মামলার রায় হয়েছে। হাইকোর্টের ৮টি বেঞ্চ থেকে এসব মামলার রায় এসেছে। এসব মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল ৭৭ জন। তাদের মধ্যে ৫০ জনেরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। শতকরা হিসাবে এটি দাঁড়ায় ৬৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

যে ৫০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন দেওয়া হয়নি, তাদের সাজা সংশোধন করে ২৫ জনকে যাবজ্জীবন বা অন্য কোনো মেয়াদে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাকি ২৫ জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। খালাস এবং অন্য মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্তের শতকরা হার দাঁড়ায় পৃথকভাবে ৩২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বাকি ২৭ আসামির ফাঁসি কার্যকরের আদেশ বহাল রয়েছে। শতকরা হিসাবে এই হার প্রায় ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

এর আগে গত ২০ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ  পর্যন্ত চলা অবকাশে হাইকোর্টের ১১টি বিশেষ বেঞ্চে ৩০টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়। এসব মামলায় মোট আসামি ছিল ৬৭ জন। এর মধ্যে ৫৮ জনের মৃত্যুদণ্ড টেকেনি হাইকোর্টে। শতকরা হিসাবে এটি দাঁড়ায় ৮৬ দশমিক ৫৬ ভাগ। এই ৫৮ জনের মধ্যে ১৭ জন খালাস পেয়েছেন এবং ৪১ জনের সাজা সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অবকাশে খালাসের হার ছিল ২৫ দশমিক ৩৭ ভাগ। অন্য মেয়াদে সাজার হার ছিল প্রায় ৬১ দশমিক ১৯ শতাংশ। তখন মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে মাত্র ৯ জনের যা শতকরা হিসাবে ১৩ দশমিক ৪৩ ভাগ। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দুই অবকাশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যেসব আসামির বিচার উচ্চ আদালতে শেষ হয়েছে তাদের অধিকাংশই গরিব-মধ্যবিত্ত ও অশিক্ষিত পরিবারের সদস্য। পাশাপাশি পলাতক ৫-৬ জন ছাড়া আসামিদের সবাই কারাগারের কনডেম সেলে আটক রয়েছেন দীর্ঘ প্রায় ৫ থেকে ৬ বছর করে।

বর্তমানে দেশের সাধারণ আইনে ৩৩টি অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। জঘন্য কোনো অপরাধে বিচারিক আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর আসামিকে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নির্জন কনডেম সেলে নেওয়া হয়। কনডেম সেলে ঢোকার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিন পাওয়ার তেমন নজির দেখা যায় না। অন্যদিকে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমতি নেওয়ার জন্য বিচারিক আদালত মামলার যাবতীয় নথি পাঠান হাইকোর্টে। হাইকোর্টের অনুমতি ব্যতীত কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায় না, যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত। এই ডেথ রেফারেন্সের বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারায় বলা হয়েছে। পাশাপাশি আসামিদেরও হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। বিচারিক আদালতের বিচারকার্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হাইকোর্টের কাছে মনে হলে কোনো মামলা পুনর্বিচারের আদেশ দিতে পারেন। মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখতে, সাজা সংশোধন করে অন্য কোনো সাজা প্রদান করতে অথবা খালাস দিতে পারেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে চলা অবকাশে নিষ্পত্তি হওয়া ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো ২০১৬ ও ২০১৭ সালে হাইকোর্টে পাঠায় বিচারিক আদালত। এসব মামলার আসামিরাও ২০১৬-১৭ সাল থেকেই কনডেমড সেলে বন্দি। আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির পর বিপুলসংখ্যক আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন মেলেনি। উচ্চ আদালতে এসে তাদের গলায় আর ফাঁসির দঁড়ি থাকছে না। এরই মধ্যে অনেক আসামি ৫ থেকে ৬ বছর করে নিঃসঙ্গ দিন কাটিয়ে ফেলেছেন কারাগারের কনডেম সেলে। দীর্ঘ কারাভোগ ও কনডেম সেলে বন্দি থাকার পর অনেক আসামি নির্দোষ ঘোষিত হলেন।

তবে এখনো বাকি রয়েছে আপিল বিভাগে তাদের বিচার। মৃত্যুদণ্ড বহাল, মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পাওয়া অথবা মৃত্যুদণ্ডের সাজা সংশোধন করে অন্য মেয়াদে সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল বিভাগে যাবেন। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতের কাছে আপিল এবং পরবর্তীতে রিভিউ আবেদন করারও সুযোগ রয়েছে সবপক্ষেরই। এই প্রক্রিয়া শেষ হতেও বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। তবে হাইকোর্টের রায় স্থগিত না হলে খালাসপ্রাপ্তরা মুক্তি পাবেন। আর অন্য সাজাপ্রাপ্তদের নেওয়া হবে সাধারণ সেলে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারিক আদালতে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ বিচক্ষণতার পরিচয় না দেওয়া, মামলার তদন্তে ত্রুটি, দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারের উপাদান (সাক্ষ্য-প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্ত) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, আসামিদের অপরাধের ধরন, বয়স, দীর্ঘ কারাভোগের বিষয়সহ নানা দিক বিবেচনায় উচ্চ আদালত থেকে এই বিপুলসংখ্যক আসামির ফাঁসির দণ্ড টেকেনি। আবার আসামিদের একটি বিরাট অংশ খালাস পেয়েছেন। হাইকোর্টে বিচার শেষে কয়েকটি মামলার বাদীপক্ষ একেবারেই বিচার পাননি। তাদের মামলার সব আসামিই খালাস পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, মামলার সব আসামি উচ্চ আদালতে এসে খালাস পাওয়ায় একদিকে বাদীপক্ষ ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ কারাভোগের পর যারা নির্দোষ ঘোষিত হচ্ছেন তাদেরও ন্যায় বিচার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মামলার উভয়পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর সমাধান হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে মতামত নেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট আইনজীবী খন্দকার মহবুব হোসেনের। তিনি  বলেন, বিচারিক আদালত থেকে ঢালাওভাবে ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে ফাঁসির বিষয়টি ‘রিয়ারেস্ট অব দ্য রিয়ার’। ব্যতিক্রমী ঘটনাতেই কেবল স্পর্শকাতর এই দণ্ড দেওয়া যায়। তবে এখন একটা চাঞ্চল্যকর মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনা না করেই মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিচ্ছে বিচারিক আদালত। পারিপার্শ্বিক চাপ অথবা আবেগতাড়িত হয়ে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেন, তারা হাইকোর্টে খালাস পেয়ে যান।

তিনি বলেন, এর মূল কারণ তদন্ত সঠিক ভাবে হচ্ছে না। সঠিক তদন্ত হলে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ সঠিকভাবে আনা হলে, এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। তদন্ত সঠিকভাবে না করলে এ ধরনের অবিচার চলবেই। মামলার উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাঝখান থেকে যারা প্রকৃত দোষী তারা বিচারের বাইরে থেকে যাবে। দক্ষ তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ, তদন্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়নো এবং পারলে পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন ও বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকৃতঅর্থে বিচারপ্রার্থীদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচার বিভাগকে ঢালাওভাবে সংস্কার করতে হবে। অন্যথায় বিচার বিভ্রাট ঘটতেই থাকবে।

তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন  বলেন, ‘আসলে কোনো পক্ষই ন্যায় বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন না। সুপ্রিম কোর্ট আসামির বয়স, কারাভোগের মেয়াদ, স্বাস্থ্যগত দিকসহ নানা বিষয় বিবেচনা করে আসামির সাজার ধরনটা পরিবর্তন করে দিচ্ছেন।’

অনুসন্ধনে দেখা গেছে, গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া অবকাশে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মো. জিয়াউল করিম ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের বেঞ্চ মোট ৩টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করেন। এতে মোট আসামি ১১জন। এর মধ্যে এক আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলেও বাকি ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড টেকেনি। যাদের মৃত্যুদণ্ড টেকেনি তদের মধ্যে ৮ জন খালাস পেয়েছেন। অপর দুই আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।

নিষ্পত্তি হওয়া তিনটি ডেথ রেফারেন্সের মধ্যে একটি ছিল কিশোর জিয়াউল হক হত্যা মামলা। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ১৯৯৪ সালের ১৩ মে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আগুয়া গ্রামের এই শিশুটি খুন হন। এ ঘটনায় জিয়ার মা রূপচান বিবি মামলা করেন। পুলিশ ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যান। বিচার শেষে ২০১৬ সালের ৯ মে বিচারিক আদালত পাঁচ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ের পর সব আসামিকে নেওয়া হয় কনডেম সেলে।

আসামিরা হলেন—বানিয়াচং উপজেলার টুপিয়াজুরি গ্রামের আলী হায়দার, একই গ্রামের নূর মিয়ার ছেলে আব্দুল আহাদ, আগুয়া গ্রামের খুরশেদ আলীর ছেলে রেনু মিয়া, আগুয়া গ্রামের শাহিন মিয়ার ছেলে হাবিব মিয়া ও আব্দুর রেজ্জাকের ছেলে রঞ্জু মিয়া। হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকাবস্থায় আব্দুল আহাদ মারা যান। বিচার শেষে হাইকোর্ট গত ১২ সেপ্টেম্বর বাকি চার আসামিকেই খালাস দেন। এতে একদিকে হত্যাকাণ্ডের ২৮ বছর পরে এসে ছেলে হত্যার বিচার পেলেন না রূপচান বিবি। অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে ৬ বছরের বেশি সময় কনডেম সেলে কাটিয়েছে খালাসপ্রাপ্ত চার আসামি। খলাসের কারণ জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আশরাফুল হক জর্জ  বলেন, ‘ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকায় সব আসামিকেই খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হবে।’

বিচারপতি এসএম ইমদাদুল হক ও বিচারপতি কেএম জাহিদ সারোয়ার কাজলের বেঞ্চ থেকেও তিনটি ডেথ রেফারেন্স মামলার রায় হয়েছে। এতে মোট আসামি ৯ জন। এর মধ্যে একজনের ফাঁসি টিকলেও বাকি ৮ জনের ফাঁসি টেকেনি। এই ৮ জনের মধ্যে ৫ জনই খালাস পেয়েছেন। বাকি তিনজনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি আ ন ম বশির উল্লাহ ও বিচারপতি মোহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের বেঞ্চ মোট চারটি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করেছেন। এতে মোট আসামি ১০ জন। ৫ জনের ফাঁসি বহাল আর ৫ জনের ফাঁসি টেকেনি। যাদের ফাঁসি টেকেনি তাদের মধ্যে চারজন খালাস পেয়েছেন। অপর আসামিকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের বেঞ্চ ৫টি ডেথ রেফারেন্সের রায় দিয়েছেন। এতে মোট আসামি ১৩ জন। ১৩ জনের মধ্যে ৭ আসামির ফাঁসি টেকেনি। ৬ জনের ফাঁসি বহাল রয়েছে। যাদের ফাঁসি টেকেনি তাদের ৬ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং অপর আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। খালাসপ্রাপ্ত কালু মিয়া ২৩ বছর আগে গাজীপুরের জয়দেবপুরে করিমন নেছা নামে এক নারী হত্যার আসামি। ২০১৭ সাল থেকেই এই আসামি কনডেমড সেলে ছিলেন। বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের বেঞ্চে দুটি ডেথ রেফারেন্স নিস্পত্তি করেছে। এতে মোট আসামি ৮ জন। এর মধ্যে ৫ জনের ফাঁসি বহাল এবং তিন আসামিকে খালাস দিয়েছেন।

অবকাশের দ্বিতীয় ধাপে গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিনটি বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়েছে। এর মধ্যে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারতি কে এম ইমরুল কায়েশের বেঞ্চ থেকে ৪টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে মোট আসামি ৯ জন। এর মধ্যে ফাঁসি বহাল একজনের। ৪ জনকে খালাস এবং ৪ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। এই চারটি ডেথ রেফারেন্সের মধ্যে আলোচিত একটি মামলা হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায় ৬০ বছরের এক গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ। এই মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামিই খালাস পেয়েছেন। যে চার আসামি খালাস পেয়েছেন তারা হলেন—কমলনগর উপজেলার চর বসু গ্রামের ছানাউল্লাহ (৩৫), সুধারাম থানার আন্ডারচর গ্রামের মো. ওহিম (২৫), চর কালকিনি গ্রামের মো. হারুন (৩০) ও একই গ্রামের আবুল কাসেম (৩০)।

চার আসামির খালাস পাওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান  বলেন, মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণের কোনো চিহ্ন নেই। আসামিদের স্বীকারোক্তি নেই। এ কারণে হাইকোর্ট চার আসামিকেই খালাস দিয়েছেন। কিসের ভিত্তিতে বিচারিক আদালত তাহলে চারজনকে ফাঁসি দিয়েছিলেন জানতে চাইলে ডিএজি বলেন, আল্লাহই ভালো জানেন, আর রায় প্রদানকারী বিচারকই ভালো জানেন। তিনি আরও বলেন, সর্বোচ্চ আদালত সর্বোচ্চ চিন্তা-ভাবনা থেকে সাজা দেন। খুববেশি শক্ত প্রমাণ না থাকলে হাইকোর্ট ফাঁসি বহাল রাখতে চান না।

বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারতি মো. বশিরউল্লাহর বেঞ্চ মোট ৫টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করেছেন। এতে মোট আসামি ১০ জন। এর মধ্যে ৭ জনের ফঁসি বহাল ও ৩ জনের যাবজ্জীবন দেওয়া রয়েছে। এ ছাড়া বিচারপতি মো. হাবিবুল গণি ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের বেঞ্চ ৩টি ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করেছেন। এতে মোট আসামি ৭ জন। এর মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকি ৬ জনকে যাবজ্জীবন দিয়েছেন। আসামিপক্ষের একজন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম উচ্চ আদালতে ফাঁসির আদেশ এত কমে যাওয়ার ব্যাপারে বলেন, বিচারিক আদালতে যারা ভালো বিচার করেন তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধস্তন আদালতে এখন বিচারের নামে সালিশ চলছে। গ্রাম্য সালিশ আর আদালতের বিচার এক জিনিস না। আদালতের বিচারের একটা প্রসিডিউর আছে। সেখানে ফৌজদারি কার্যবিধি, পেনাল কোড ও এভিডেন্স অ্যাক্ট আছে। সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অন্য আইনগুলোও আছে। এসব আইনের মধ্যে থেকেই বিচার করতে হয়; কিন্তু অধস্তন আদালতের বিচারকরা একটা আবেগের মধ্যে থেকে বিচার করেন। বিচারের নামে সালিশ করে ফেলেন। যেটা আইনত কাম্য নয়। তিনি বলেন, একজনের স্বীকারোক্তিতে ৫ জনের নাম আসলে, ওই ৫ জনের বিরুদ্ধে কোন ইন্ডিপেনডেন্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলেও তাদের ফাঁসি হচ্ছে। ঢালাওভাবে আবেগের বশবর্তী হয়ে সাজা দেওয়ায় ওপরের কোর্টে এসে তা আর টিকছে না।

‘মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে বেশি, কার্যকর কম’ : গত ২৪ মে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির ২০২১ সালের জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘করোনা মহামারি পরিস্থিতির মধ্যেও ২০২১ সালে বিচারিক আদালতে অন্তত ১৮১ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতের সংখ্যা বেড়েছে ৬৮ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১১৩। সংস্থাটির পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে ২০২১ সালে ১৪৪ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭৭। পাকিস্তানে ২০২১ সালে প্রাণদণ্ড হয়েছে অন্তত ১২৯ জনের, আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ২৯। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশগুলোর চারটিই মধ্যপ্রাচ্যের। তবে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কার্যকর হয় কম। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও ব্লাস্টের উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৩১ বছরে ১০১ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। চূড়ান্ত বিচারে সর্বোচ্চ আদালতে মৃত্যুদণ্ড একেবারেই কমে যাওয়ায় কার্যকরও কম হচ্ছে।

‘বেশিরভাগই গরিব’: অনুসন্ধানে দেখা যায়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ব্যতিক্রম দু-একজন বাদে প্রায় সবাই গবির-মধ্যবিত্ত, অশিক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের সদস্য। এর আগে গত জুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের উদ্যোগে ও ব্লাস্টের সহযোগিতায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৯ জনের মামলা নিয়ে এক গবেষণাপত্রেও বিষয়টি উল্লেখ আছে। ওই গবেষণায় বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। এ ছাড়া ৪৬ শতাংশ মামলায় দেখা যাচ্ছে, ঘটনার তারিখ থেকে হাইকোর্টে মামলা নিষ্পত্তি হতে ১০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। হাইকোর্ট বিভাগে মামলা গড়ে নিষ্পত্তি হতে সাড়ে পাঁচ বছর সময় লেগেছে। গত ৬ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের চেয়ারম্যান বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আইন ধনীদের জন্য বেশি এগিয়ে চলে। গরিবের অর্থ নেই। ফলে আইন তাদের পক্ষে অনেক সময় থাকে না।’

‘৬ বছরের পুরোনো’ : সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, প্রায় সাড়ে আটশ ডেথ রেফারেন্স মামলা বিচারাধীন হাইকোর্টে। বর্তমানে হাইকোর্টে ২০১৭ সালে নিবন্ধনকৃত ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি চলছে। অর্থাৎ প্রায় ৬ বছর আগে হাইকোর্টে পাঠানো ডেথ রেফারেন্সগুলোর বিচার চলছে। তবে ডেথ রেফারেন্স বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতা কমাতে উদ্যোগ নিয়েছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি।

‘চূড়ান্তের আগে কনডেম সেলে রাখা নিয়ে প্রশ্ন’ : এদিকে বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগেই আসামিকে কনডেম সেলে পাঠানোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে তিন বন্দির করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি করে গত ৬ এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল দিয়েছেন। রুলে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। রিটে বলা হয়, হাইকোর্ট থেকে আসামির মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার আগে আসামিকে কনডেম সেলে নিয়ে মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন করা হচ্ছে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার বিধান রয়েছে। আপিল করার পর তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কারও ফাঁসি কার্যকর করা যায় না। একইভাবে রিভিউ আবেদন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদনও করতে পারেন একজন আসামি। এসব প্রক্রিয়া নিষ্পত্তির আগে আসামিকে কনডেম সেলে নেওয়ায় সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
সূত্র কালবেলা

আরও খবর: জাতীয়