জাতীয়

ইন্সপেক্টররা এক একজন ‘জামাই’

  প্রতিনিধি ৪ মার্চ ২০২৪ , ৬:৪২:০৮ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডে

 

কোনো জমির মালিক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে ভবনের নকশা অনুমোদনের আবেদন করলে প্রথমেই লাগে ইমারত পরিদর্শকের (বিল্ডিং ইন্সপেক্টর) মতামত। স্থান পরির্দশন করে পরিদর্শকের মতামত ইতিবাচক না হলে নকশা অনুমোদনের আবেদন ‘গোড়ায় গলদ’ হয়ে যায়। তখন থেকেই শুরু হয় ইন্সপেক্টরদের উৎকোচ বাণিজ্য। এর পর ভবন তৈরির সময় নানা অনিয়মের ধুয়ো তুলে চলে বাণিজ্য। পুরো কাজ শেষ হওয়ার পরও থামে না তাদের ‘যন্ত্রণা’। আবাসিক ভবনের অ-আবাসিক ব্যবহারসহ নানা ছুতোয় ইন্সপেক্টরদের বাণিজ্য চলতেই থাকে। এ জন্য রাজউকে ইন্সপেক্টরদের আরেক নাম ‘জামাই’।

রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনে পুড়ে কঙ্কাল হওয়া গ্রিন কোজি কটেজের অনুমোদনের সময় ওই এলাকার ইন্সপেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন সেলিম বকাউল। ২০১৫ সালে ওই এলাকার ইন্সপেক্টর হয়ে আসেন আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু। পরে নান্নু বদলি হয়ে চলে যান বনানী এলাকায়। নান্নু বনানী এলাকায় দায়িত্ব পালনের সময় ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নান্নু আসামি ছিলেন। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়ে আবার সিদ্ধেশ্বরী এলাকার দায়িত্বে আসেন। আর সিদ্ধেশ্বরী থেকে মোহাম্মদপুরে বদলি করার পর সেলিম বকাউলের বিরুদ্ধে স্থানীয় ভবন মালিকদের কাছ থেকে নানা উসিলায় উৎকোচ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। তখন সেলিম বকাউলকে নবগঠিত গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (গাউক) বদলি করা হয়। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে সেই বদলি বাতিল করে আবার মহাখালীতে চলে এসেছেন বকাউল। তাঁর স্ত্রী মোসা. নাসরিন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) উচ্চমান সহকারী পদে চাকরি করায় সেলিম বকাউল চলেন বুক ফুলিয়ে। রাজউকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও তাঁকে সমীহ করে চলেন।

এই প্রতিবেদক নান্নু ও বকাউলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। এরই মধ্যে আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু ও সেলিম বকাউল পদোন্নতি পেয়ে চিফ ইন্সপেক্টর বনে গেছেন। আর এক বছর আগে চাকরিতে যোগ দেওয়া সুব্রত কর্মকার তাঁর অধীনে ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। চাকরিতে নবীন হলেও সিদ্ধেশ্বরীর এক ভবন মালিকের কাছ থেকে এভাবে ১ লাখ টাকা উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে সুব্রত কর্মকারের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে সুব্রত কর্মকারকে বারবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। খুদেবার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।

জানা যায়, রাজউকে বর্তমানে ২৪ অঞ্চলে (জোন) মোট ২৪০ জন ইন্সপেক্টর দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিটি জোনে কমবেশি ১০ জন করে কাজ করেন। তাদের মূল দায়িত্ব ভবনটি সঠিকভাবে তৈরি হচ্ছে কিনা। আর ভবনটির ব্যবহার সঠিক আছে কিনা।

ভবন মালিকদের অভিযোগ, ইন্সপেক্টররা ভবন তৈরির সময় বা নির্মিত ভবন দেখতে মাঝেমধ্যেই মাঠ পরিদর্শনে যান। গিয়েই ভবনের খুঁত খুঁজতে থাকেন। কোনো ত্রুটি পেলেই ভবন মালিকের নামে নোটিশ জারি করে। এর পরই ভবন মালিক দেনদরবার শুরু করেন। ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেন ইন্সপেক্টররা। ভবন মালিকদের সঙ্গে দেনদরবারের জন্য প্রত্যেক ইন্সপেক্টরের দু-তিনজন বহিরাগত ভাড়াটে লোক রাখা আছে। এরা ‘গ্যাটিস’ নামে পরিচিত। ৩/১ নম্বর জোনের (শাহআলীবাগ) ইন্সপেক্টর সাদ্দাম হোসেনেরও এ রকম দুজন ‘গ্যাটিস’ আছেন। তাদের একজনের নামে এনামুল। মাস দুয়েক আগে শাহআলীবাগের ধানক্ষেতের মোড়ে একটি দশ তলা ভবনে পরিদর্শনে গিয়ে ভবনের নানা ত্রুটি ধরেন সাদ্দাম হোসেন। নকশা অনুযায়ী ভবন হয়নি বলে হম্বিতম্বি করেন। পরে নোটিশ দিলে ভবন মালিক মিজানুর রহমান ও সাজ্জাদুর রহমান ইন্সপেক্টর সাদ্দামের শরণাপন্ন হন। এনামুলের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দাবি করলে পরে ৫ লাখ টাকায় রফা হয়।

এ প্রসঙ্গে বর্তমানে ছুটিতে থাকা সাদ্দাম হোসেন জানান, কাজের চাপের কারণে এনামুল তাঁকে একটু সহযোগিতা করে। তবে এ ধরনের কোনো টাকা ওই ভবন মালিকের কাছ থেকে তিনি নেননি। এনামুলও খারাপ ছেলে না। তার পরও ছুটি শেষে এনামুলকে জিজ্ঞেস করবেন বলে জানান।

রাজউকের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ইন্সপেক্টরদের এ ধরনের বাণিজ্য দীর্ঘদিন ধরে চললেও যিনি উৎকোচ দেন, ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতির শঙ্কায় চুপ থাকেন। অনেকটা নীরবেই সহ্য করেন ভবন মালিকরা। কারণ রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভবনই কোনো না কোনো ভাবে নকশার ব্যত্যয় করে গড়ে উঠেছে। এই সুযোগই ইন্সপেক্টরদের হাতিয়ার।

কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, আগে শুধু ইন্সপেক্টরদের ম্যানেজ করলেই হতো। বছরখানেক হলো রাজউক কোনো নোটিশ দিলে নোটিশের অনুলিপি স্থানীয় থানা পুলিশের কাছে পাঠায়। এ সুযোগে ওই নোটিশের কপি নিয়ে অনেক সময় থানা পুলিশও ওই বাড়ির মালিকের কাছে হাজির হন। নগরের ঝুঁকি কমানোর জন্য এই নিয়ম চালু করা হলেও তা নগরবাসীর জন্য আরেক ‘আপদ’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

এ ব্যাপারে রাজউকের মুখপাত্র ও প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, বেইলি রোড ট্র্যাজেডির পর ইন্সপেক্টরদের বলে দিয়েছি, এসব বন্ধ করতে। ইন্সপেক্টররা ঠিকমতো তদারক করবে না। আর তাদের কারণে রাজউকের দুর্নাম হবে, তা হবে না। প্রয়োজনে সিলগালা করে দেবে ভবন। তাহলে হুমকি এলেও অন্তত জেল হবে না। আর এখন তো ফাঁসিতে যাওয়ার উপক্রম।

 

আরও খবর: জাতীয়