অর্থনীতি

অস্বস্তিতে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পর বিদেশি পাচারকারীরা

  ঢাকা অফিস ২৫ আগস্ট ২০২৩ , ৩:০৭:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

সংগৃহীত

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কঠোর আইনি পদক্ষেপের কারণে ছোট হয়ে আসছে অর্থ পাচারকারীদের দুনিয়া। পাচার হয়ে আসা অর্থ বাজেয়াপ্ত করতে কোথাও চলছে অভিযান, কোথাও বা পাচারকারীদের ধরতে করা হচ্ছে নতুন আইন। এ কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই অস্বস্তিতে আছেন নিজ দেশে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পর বিদেশি পাচারকারীরা।

বিলাসী জীবনযাপনের নিশ্চয়তা এবং ‘ট্যাক্স হেভেন’ সুবিধা পাওয়ার আশায় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচারের জন্য এতদিন নিরাপদ গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং বেশ কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। পাচারকারীদের কাছে অবৈধ অর্থ স্থানান্তরের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল সিঙ্গাপুরও। এসব দেশে অর্থ পাচারকারীদের তালিকায় অনেক বাংলাদেশিও আছেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অর্থ পাচার প্রতিরোধে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর ধারণা, বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতিবাজরা সিঙ্গাপুরে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন। ওই অর্থে তারা সেখানে ফ্ল্যাট, বাড়ি-গাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিলাসী জীবনযাপন করছেন।

গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) দেওয়া তথ্যমতে, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে, প্রতিবছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।

অন্যদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। ওই সময়ের বাজারদর অনুযায়ী (৮৫ টাকায় প্রতি ডলার) এর পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে গড় অর্থ পাচারের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত , যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।

তবে অর্থ পাচারকারীদের এতদিন যেসব দেশ নিরাপদ ছিল, তাদের অনেকেই পাচার হয়ে আসা অর্থের বিরুদ্ধে কঠোর হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসন বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি ও সেখান থেকে অর্জিত অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। দেরিতে হলেও এখন টনক নড়েছে সিঙ্গাপুর সরকারেরও। ফলে অবৈধ অর্থ অনুপ্রবেশের এই স্বর্গরাজ্যটিও আর অর্থ পাচারকারীর কাছে নিরাপদ নয়।

 মূলত মার্কিন প্রশাসনের অনুরোধেই অবৈধ অর্থের স্বর্গরাজ্য থেকে সিঙ্গাপুরকে সুরক্ষিত রাখতে অর্থ পাচারবিরোধী এমন সাঁড়াশি অভিযানে নামে দেশটির পুলিশ।

এ লক্ষ্যে তারা আগেই অর্থ পাচারকারীদের একটি সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করেছে। এখন সেই অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম দিনের অভিযানেই ১০০ কোটি ডলারের অর্থসম্পদ জব্দসহ ১০ দেশের বিভিন্ন দেশের পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে অবৈধ অর্থের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নিজ ভূখণ্ডে বিদেশিদের বাড়ি কেনা বন্ধের আইন করেছে কানাডা সরকার। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তৈরি করা আইনটি চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে।

অর্থ পাচারবিরোধী ব্যবস্থা নিচ্ছে অস্ট্রেলিয়াও। সেখানেও গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়াতেও বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদের প্রায় সবাই বিদেশি শিক্ষার্থী। এদের কারও কারও পেট্রোলপাম্প ও কফিশপসহ অন্যান্য ব্যবসা আছে।

অতি সম্প্রতি সেন্ট্রাল লন্ডনের কেনসিংটনের মতো বিলাসবহুল এলাকায়ও বাংলাদেশিদের ৯৮টি বাড়ির সন্ধান মিলেছে। যুক্তরাজ্যের হাউস বিল্ডিং শিল্প খাতবিষয়ক সাময়িকী শোহাউস জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, লন্ডনের সম্পত্তিতে বিনিয়োগকারী শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নবম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যাদের বেশিরভাগই অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ নিয়ে সেখানে বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্প চালু করেছে। এর আওতায় এখন পর্যন্ত আট হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম সুবিধা নিয়ে মালয়েশিয়ায় ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছেন বলে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিদেশি নাগরিকদের স্থায়ী বসবাস বিবেচেনায় বাংলাদেশিদের অবস্থান তৃতীয়। দুদক সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে ৬৪৮ বিশিষ্ট ব্যক্তিও রয়েছেন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৮৭, বিএনপি-জামায়াতের ৯৬ এবং বাকি ২৬৫ জন সুবিধাভোগী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও আমলা। গত পাঁচ বছরে অন্তত ৪ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ মার্কিন ডলার মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে এখনো আমি ওয়াকিবহাল নই। না জেনে কোনো কথা বলতে পারব না।’

আরও খবর: অর্থনীতি