অর্থনীতি

অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ, একযুগে ৮৬,৬৭০ কোটি টাকা প্রদান

  প্রতিনিধি ৩ নভেম্বর ২০২২ , ৩:০৪:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ

 নীলাকাশ টুডেঃ

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)।

একই সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ (ক্যাপাসিটি চার্জ) কবে নাগাদ বন্ধ হবে সে বিষয়েও জানতে চেয়েছে।

আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে।

সেখানে বিদ্যুৎ, ব্যাংক ও বাণিজ্য খাত নিয়ে আলোচনা করেন তারা। আইএমএফ মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাহুল আনন্দ। এ সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, বিদ্যুৎ খাতে লাগামহীন ভর্তুকি দিতে থাকলে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ থামবে না। এ কারণে চাপে থাকবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। এছাড়া তারা পণ্যের ট্যারিফ ব্যবস্থা যৌক্তিকীকরণ, এলডিসি উত্তরণের পর প্রস্তুতি এবং ব্যবসা সহজীকরণের বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চান। ঋণের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে সেগুলোও মানার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা বলেছেন। জানিয়েছেন, এগুলো না মানলে ঋণ মিলবে না।

পিডিবির সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যুতের ভর্তুকি কমাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া যায় কিনা পিডিবির কাছে জানতে চায় আইএমএফ। পিডিবি বলেছে, সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান হিসাবে এভাবে ভর্তুকির জন্য ঋণ নেওয়া যাবে না। ঋণ নিয়ে সেটি পরিশোধ করতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ (ক্যাপাসিটি চার্জ) কবে বন্ধ হবে সেটি জানতে চেয়েছে।

বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। ২০৩০ সালেও এটি শেষ হবে না। এ খাতে কত ব্যয় হবে, এগুলোর কারণে সরকারের ঋণ কেমন বাড়ছে সে সম্পর্কেও জানতে চায় মিশনটি। তারা মনে করে, সরকারের ঋণের টাকায় ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধের কারণে এতে সংকট আরও বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ থেকে বিরত থাকতে বলেছে আইএমএফ। তাদের শঙ্কা ভবিষ্যতেও বৈদেশিক ঋণের টাকায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হবে। এভাবে এ অর্থ পরিশোধ করলে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থেকে বাংলাদেশ যেমন বের হতে পারবে না, তেমনি অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিও কমবে না।

সূত্র জানায়, ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১২ বছরে প্রায় ৮৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে দিয়েছে সরকার। এ অর্থ দিয়ে প্রায় তিনটি পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ হাজার ২১ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এগুলো সবই বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়েছে। ওই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় অনেক সময় কেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল। এসব কোম্পানির উৎপাদন ব্যয় বেশি। এদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে সরকার গ্রাহকদের কাছে কম দামে বিক্রি করে। যে কারণে সরকারকে এ খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

এদিকে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুৎ বিভাগকে দেওয়া চিঠিতে ক্যাপাসিটি চার্জে লাগাম টানার কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে আইএমএফের শর্তে লোকসান ও ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ও ক্যাপাসিটি চার্জ কমানোর কথা বলা হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের চাপ বাড়ায় নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও চালু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বৈঠক শেষে পিডিবি কার্যালয় পরিদর্শন করেন আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। এ সময় পিডিবির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের প্রতিনিধি দলটি মূলত তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছিল।

তারা বেশকিছু বিষয়ে জানতে চেয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধি দলের নেতা পিডিবি চেয়ারম্যানকে বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকির টাকা না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুবিধাজনক হয় কিনা। এ প্রশ্নের উত্তরে পিডিবির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য ভায়াবেল হবে না।

বিদ্যুৎ পাওয়াটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার পূরণ করার জন্য সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়। এজন্য সরকার কিছু দায় নেয় এবং এই খাতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে পিডিবিকে ঋণের অর্থ এবং সুদ দুটি পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিলে তা পরিশোধ করতে হয় না। এটি আমাদের জন্য সুবিধাজনক।’

আইএমএফ প্রতিনিধি দল জানতে চায়, সরকার ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে পিডিবি কী করবে। জবাবে পিডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তখন পিডিবি সরকারের নীতি মেনেই কাজ করবে। এদিকে আইএমএফ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বন্ধ করার সুপারিশ করেছে।

আইএমএফ প্রতিনিধি দলের প্রশ্ন ছিল, এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে, সেটি ২০৩০ সালে শেষ হবে কিনা। পিডিবি জানায়, সেটি সম্ভব নয়। কারণ, নতুন নতুন বেশকিছু আইপিপি আসছে। তাদেরও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। এখন আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি যে, কবে নাগাদ ক্যাপাসিটি চার্জ শেষ করা যাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। পাশাপাশি রপ্তানি বাড়াতে নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানো, অশুল্ক বাধা দূর ও পণ্যের ট্যারিফ হার যৌক্তিকীকরণে কি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সংস্থাটি তাও জানতে চায়।

সেখানে আগামী তিন অর্থবছরের (২০২৩-২৬) পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের উদ্যোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়।

আইএমএফের ৫ প্রতিনিধি বৈঠক করেছেন সিনিয়র বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষসহ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

বৈঠকে রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্যের বহুমুখীকরণ পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছানোর পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি কি রয়েছে বাংলাদেশের জানতে চেয়েছে সংস্থাটি।

এছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ও পণ্য রপ্তানি নিয়ে প্রস্তুতি কি বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। এ সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয় ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ পরবর্তীতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির কাজে সহায়তার জন্য আরও ৭টি সাবকমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলো এ বিষয়ে কাজ করছে।

আইএমএফ জানতে চায়, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কি করছে। জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও শ্রীলংকার সঙ্গে এফটিএ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে আরও ৯টি দেশের সঙ্গে। তবে ইন্দোনেশিয়া ও নেপালের সঙ্গে শিগগিরই প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে। সেখানে আরও বলা হয়, ভুটানের সঙ্গে এফটিএ হয়েছে। এছাড়া জাপান ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে। আগামীতে নেপালের সঙ্গে হতে পারে। এ ছাড়া দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির লক্ষ্যে ২৩টি দেশের সঙ্গে সম্ভাব্য সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।

ট্যারিফ হার যৌক্তিকীকরণ করার পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। বিপরীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা ট্যারিফ পলিসি প্রণয়ন করছি। এছাড়া যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে আরোপিত কাস্টমস শুল্ক ডব্লিউটিও-এর বন্ড ডিউটি হার সীমা অতিক্রম করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে শুল্ক হার উক্ত সীমার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। পর্যায়ক্রমে আমদানি পর্যায়ে প্রযোজ্য প্যারা-ট্যারিফ এবং সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করা হবে।

ব্যবসা সহজীকরণ করার বিষয়ে জানতে চায় সংস্থাটি। ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে আরও জোরদার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ বলেছে, ঋণ পেতে শর্ত দেওয়া হয়েছে। এসব শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার, মাত্রারিক্ত খেলাপি ঋণ হ্রাস, রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি, ঋণে সুদ হারের সীমা বাতিল, একক ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি ইস্যুতে অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইএমএফ মিশন প্রধান শর্তের বিষয়গুলো হালনাগাদ করার তাগিদ দেন। এ সময় গভর্নরের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের আশ্বাস দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, গত কয়েক দিনের অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিভিন্ন নথি থেকে প্রাপ্ত বিষয় সম্পর্কে তারা গভর্নরকে জানান এবং এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের তাগিদ দেন। তারমধ্যে অন্যতম হলো-রিজার্ভ হিসাবে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ, ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার, মাত্রারিক্ত খেলাপি ঋণ হ্রাস, ঋণে সুদ হারের সীমা বাতিল, বিনিময় হার, অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ মঞ্জুর, বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়মের বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে ভর্তুকি বাতিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আইএমএফের শর্ত খুব এটা কঠিন নয়। এগুলো চাইলে সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে। এতে একটা সমস্যা হলো যে হঠাৎ করে খেলাপি বেড়ে যাবে। আবার রিজার্ভ কম দেখাবে। এতে তো কোনো সমস্যা নেই। বরং বাস্তবায়ন করলে অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। এখন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সবকিছু।’ সূত্র যুগান্তর

আরও খবর: অর্থনীতি