জাতীয়

অপরাধ সাম্রাজ্যে বেপরোয়া উত্থান ঘটেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী রানার!

  প্রতিনিধি ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৪:২৮:৩৭ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডেঃ রাজধানীর ঢাকার অপরাধ সাম্রাজ্যে বেপরোয়া উত্থান ঘটেছে শীর্ষ সন্ত্রাসী রানা মোল্লা ওরফে ল্যাংড়া রানা বাহিনীর। বিদেশে পলাতক বিলুপ্ত সেভেন স্টার গ্রুপের একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে দাপট দেখাচ্ছে এই বাহিনীর সদস্যরা। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক। এদের কাছে মজুত আছে পার্বত্য এলাকা থেকে আনা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। এসব অস্ত্র বেচাকেনার পাশাপাশি ‘কন্ট্রাক্ট কিলিং’ মিশনে ভাড়া খাটায় তারা। ঢাকায় বিপদ টের পেলেই বাহিনীর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা গা ঢাকা দেয় দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে। মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মুগদাসহ ঢাকার আশপাশের বড় অংশের অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ এখন এই বাহিনীর হাতে। অনেক আগে থেকে বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিয়ে এলাকায় নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এরপর সম্রাট, খালেদসহ অন্যরা জেলে যাওয়ার পর তার প্রভাব আরও বাড়ে। সর্বশেষ টিপু খুনের পর নিজেই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল হক টিপু হত্যার আসামি ও ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেফতার আলোচিত কয়েক নেতাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এদের সম্পর্কে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া একাধিক মামলার তদন্তে রানা বাহিনীর বেপরোয়া উত্থানের চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

নতুন করে সুসংগঠিত পুরোনো এই সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থান সম্পর্কে কথা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুণ-অর-রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অপরাধজগতে রানার নাম পুরোনো। নতুন-পুরোনো সব ধরনের সন্ত্রাসীর দল-উপদল আছে। তাদের সবার গতিবিধির ওপর আমাদের নজর আছে।  তিনি বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অনেককেই গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে অপরাধ সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের হাতবদল সম্পর্কে কিছু তথ্য মিলেছে। সেখানে অনেকের নাম এসেছে। টিপু হত্যাকাণ্ডের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোনো গ্রুপের সন্ত্রাসীরা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে কি না, এ সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।’

পুলিশ ও অপরাধজগতের সূত্রে জানা যায়, একসম য়ের আলোচিত ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপের হয়ে কাজ করতে গিয়েই অস্ত্রবাজিতে রানার হাতেখড়ি। ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জের জগন্নাথপুর গ্রামে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেই সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ডাকসুর সাবেক এক শীর্ষ নেতা, এবং বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ক্যাডার হিসাবেও তার পরিচিতি আছে। ওই নেতার শেল্টারেই মূলত রানা গড়ে তোলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী এবং অস্ত্র ব্যবসার নেটওয়ার্ক। তার গ্রুপ অপরাধজগতে ‘ল্যাংড়া রানা বাহিনী’ হিসাবে পরিচিত।

জানা যায়, ২০০৮ সালে মিরপুরের কাজীপাড়ায় অ্যাপোলো নামের একজনকে হত্যা করেই আলোচনায় আসেন রানা মোল্লা ওরফে ল্যাংড়া রানা। ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ‘কন্ট্রাক্ট কিলার’ হিসাবে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে তার বাহিনীর কদর বাড়তে থাকে। এর আগে বিএনপি আমলে তার সখ্য গড়ে ওঠে বিএনপির প্রয়াত নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বিধান বড়ুয়া (বর্তমানে জেলে), ইকবাল, ফাইভ স্টার জসিমসহ পার্বত্য অঞ্চলের একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে। তাদের যোগসাজশে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে কন্ট্রাক্ট কিলার হিসাবে গড়ে তুলে ‘ক্লুলেস মার্ডার চেইন’। টিপু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগেও রানার কিলার বাহিনীর সদস্য পটিয়ার আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, রাউজানের ইয়াসির আরাফাত সৈকতকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের কাছে পাওয়া তথ্যে গ্রেফতার করা হয় শাজাহানপুর এলাকার হাফিজকে। চট্টগ্রামের সৈকত ও সালেহ ঢাকায় আত্মগোপনে থেকে রানা বাহিনীর অস্ত্রবাজ হিসাবে কাজ করত।

জানা যায়, ১৯৯১ সালে মতিঝিলের অফিসপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অপরাধ সাম্রাজ্যের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নেতৃত্বাধীন সেভেন স্টার গ্রুপের আন্ডারকাভার হ্যান্ডস রানা মোল্লা ও খালেদ গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। ওই ঘটনায় রানা ও সদ্য কারামুক্ত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া পায়ে গুলিবিদ্ধ হলে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তখন থেকে দুজনের নামের সঙ্গে ‘ল্যাংড়া’ বিশেষণ যুক্ত হয়। রানা বাহিনীর অস্ত্রবাজের তালিকায় আছে পুরান ঢাকার বাবু, ধনিয়ার পলাশ, শামীম ও মুগদার পিয়াস। এরা কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের পাশাপাশি অস্ত্র বেচাকেনা ও ভাড়ার কারবারে সক্রিয়। ক্যাসিনো-কাণ্ডে আলোচিত বহিষ্কৃত কৃষক লীগ নেতা কালা ফিরোজের ক্যাডার হিসাবেও কাজ করে রানা বাহিনী। তবে বর্তমানে দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টির ঢাকার শুটার হিসাবে কাজ করছে রানার অস্ত্রবাজরা। এদের কাছে ডজনখানেক অত্যাধুনিক অস্ত্র আছে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে একটি একে-২২ রাইফেলসহ কামাল হোসেন ও সাইদুল ইসলাম মজুমদার নামে দুজনকে গ্রেফতার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এ নিয়ে রানার সঙ্গে অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় রাঙামাটি, বান্দরবানকেন্দ্রিক অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। এই বিরোধ মেটাতেও মধ্যস্থতা করেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। গত বছরের ৩০ মার্চ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঠিকাদার আরব আলীকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা চালায় রানা বাহিনী। এ ঘটনায় রাজধানীর পল্লবী থেকে দুলাল, সাইফুল এবং চাঁদপুরের হাইমচর থেকে শাজাহান সাজুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে রানা ও যুবরাজের হয়ে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় কন্ট্রাক্ট কিলিং চালাত তারা। রানার সহযোগী নুর আমিন ওরফে নুরা পেশাদার কিলার। তার নেতৃত্বে পিচ্ছি আল আমিন, সাদ্দাম, শরফুদ্দিন ওরফে শরিফসহ ১০/১২ জনের একটি গ্যাং বাড্ডা, গুলশান, রামপুরা এলাকায় অতিমাত্রায় সক্রিয়। বনানীতে রিক্রুটিং এজেন্সি অফিসে গুলি করে ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমানকে হত্যা ও চারজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় এই গ্রুপের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।

পার্বত্য এলাকার একটি গ্রুপ সূত্রে জানা যায়, ক্যাসিনো-কাণ্ডে আলোচিত যুবলীগ নেতা সম্রাট ও খালেদ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুরু হয়েছে নতুন হিসাবনিকাশ। সম্রাট-খালেদকে মোকাবিলা করতে রানা গ্রুপকে ব্যবহার করছে দুবাইয়ে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। এজন্য বিদেশে বসেই জিসান রানা গ্রুপকে সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। খালেদের সহযোগীরাও সক্রিয়, সতর্ক অবস্থানে। এ নিয়ে গুমট পরিস্থিতি বিরাজ করছে অপরাধজগতে। গোয়েন্দারা জানান, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর পূর্ব বাড্ডার আলিফনগর এলাকায় জিসানের নামে চাঁদা তুলতে গিয়ে ডিবির হাতে গ্রেফতার হয় সন্ত্রাসী নাসির। তাকে জিজ্ঞাসাবাদেও জিসান ও রানার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছে ডিবি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেফতার বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমের হয়েও কাজ করছে রানা মোল্লা। শামীমের বিভিন্ন প্রকল্পের উপঠিকাদার হিসাবে কাজ করা ব্যক্তিদের কেউ বকেয়া পাওনা চাইতে গেলে রানার অস্ত্রবাজরা তাদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। এ কাজে লাগানো হচ্ছে ওসমান, বাবু, হৃদয়, রাসেল, ইমন, শরীফকে। এছাড়াও বিলুপ্ত সেভেন স্টার গ্রুপের শীর্ষ সন্ত্রাসী ভারতে পলাতক সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদের জন্য চাঁদা তুলে পাঠাচ্ছে রানা, তার সহযোগী রনক ও পলাশ। মাঝেমধ্যে তাদের দেখা যায় কারাবন্দি বহিষ্কৃত কৃষক লীগ নেতা কালা ফিরোজের অফিসে। কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আস্তানায়ও তাদের যাতায়াত বেড়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত চাঁদাবাজিতে জড়িত রানা বাহিনী। রাজধানীর অপরাধ সাম্রাজ্যের একাংশসহ কেরানীগঞ্জ, সাভার, সিংগাইর, নবাবগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রানা বাহিনীর দাপট। ঢাকার বাইরে নিজ এলাকা হযরতপুরেই অন্তত ১৫টি হত্যাকাণ্ডে রানার নাম আলোচিত। এর মধ্যে স্থানীয় খালেক মেম্বারের স্ত্রীসহ জোড়া খুন, পাহারাদার আনু মিয়া খুন, চরআলগীর চর গ্রামের জালাল মেম্বার হত্যা, মসজিদের ভেতর নামাজরত অবস্থায় ইয়ার হোসেনকে হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

আরও খবর: জাতীয়