অর্থনীতি

ডলারের দাম বেঁধে দেয়া ও প্রত্যাহারের নেপথ্যে

  প্রতিনিধি ৩ জুন ২০২২ , ৩:৫৭:০৭ প্রিন্ট সংস্করণ

 

নীলাকাশ টুডেঃ সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হলে সংকট মোকাবিলায় দাম বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বেঁধে দেয়া সীমা ৩ দিনের মাথায় প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূলত ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস পায়। রপ্তানি বিল নগদায়ন হচ্ছিল না। পাশাপাশি রিজার্ভ সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এসব বিষয় আমলে নিয়েই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সংস্থাটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া রেটে রেমিট্যান্স সংগ্রহ ও আন্তঃব্যাংক লেনদেন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানি বাজারে। আর রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাও দেখা দেয়। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের দাম বেঁধে দেয়া ঠিক হয়নি বলে মনে করেন তারা। তবে চাহিদা ও জোগানের ওপর নির্ভর করে ডলারের বাজার ওঠানামা করতে পারে।

এছাড়া বিভিন্নভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। এটি ডলারের বিপরীতে টাকাকে দুর্বল করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত রোববার ডলারের দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় প্রবাসী আয় সংগ্রহ কমেছে বলে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। এতে দেশে রিজার্ভ সংকট বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। আর রেমিট্যান্স কমছে হালনাগাদ প্রতিবেদনেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ডলারের দাম বেঁধে দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে আমরা সরে এসেছি। আর ডলারের সীমা তুলে দেয়ার বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ও চাহিদা বিবেচনায় ডলারের দাম ঠিক করবে। প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম বাজারমূল্যে নির্ধারণ হওয়ায় আমদানিতেও একইভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হবে। পাশাপাশি রপ্তানি আয় নগদায়ন হবে বাজারমূল্যে। ব্যাংকগুলো যে দামে ডলার কিনবে, বিক্রি করবে এর চেয়ে কিছু বেশি দামে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের একটা রেট প্রস্তাব করেছিল। সেটা ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলো বেঁধে দেয়া রেটের কারণে বিদেশ থেকে তেমন একটা রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারছে না।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলারের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। তবে হঠাৎ যেন ডলারের দাম বেশি বাড়িয়ে না ফেলা হয়, সেদিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো যাতে দাম বেশি বাড়াতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখার তাগিদ দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগেও বলেছি এখনো বলছি ডলারের দাম হঠাৎ করে বা চট করে বেঁধে দেয়াটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। কারণ এর কার্যকারিতা ভালো হয় না। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ চিন্তাভাবনা করা উচিত। এখন সংকট কাটাতে আমদানিতে লাগাম টানতে হবে। প্রয়োজনে কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, রপ্তানি আয় যারা ধরে রেখেছে বা দেশে আনেনি, তা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারি অন্য সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। আর কারা খোলাবাজার থেকে এত ডলার কিনলো, তার তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান জোরদার করতে হবে।

৮ দফা কমেছে টাকার মান: ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবনমন অব্যাহত রয়েছে। সবশেষ দফায় ৯০ পয়সা কমে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা। এ নিয়ে চলতি বছরে ৮ দফা কমানো হলো টাকার মান। জানুয়ারিতে ডলারের বিনিময় মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২৩শে মার্চ ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা দর নির্ধারণ করা হয়। ২৭শে এপ্রিল বাড়ানো হয় আরও ২৫ পয়সা। তখন ১ ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। ৯ই মে ডলারের বিনিময় মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এরপর ১৬ই মে দেশের ইতিহাসে একদিনে সবচেয়ে বড় অবমূল্যায়ন করা হয়। সেদিন টাকার মান ৮০ পয়সা কমিয়ে ডলারের বিপরীতে দর নির্ধারণ করা হয় ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর ২৩শে মে টাকার মান আরও ৪০ পয়সা কমিয়ে দর নির্ধারণ করা হয় ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা। অবশ্য খোলাবাজারে ডলারের দাম আরও বেশি। সবশেষ ১০৪ টাকাতেও ডলার কেনা-বেচা হয়েছে।

এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া রেটে রেমিট্যান্স সংগ্রহ ও আন্তঃব্যাংক লেনদেন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমদানি-রপ্তানি বাজারে। আর রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে ডলারের দাম নির্ধারণ করে লেনদেন চলবে। আর আগামী ১৬ তারিখে আমরা ব্যাংকার্স সভায় সার্বিক বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তুলে ধরবো। এদিকে মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি জোরদার করেছে। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে প্রতিদিন বেলা ১১টার মধ্যে ব্যাংকগুলোকে বিনিময় হারের ৩টি তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমদানির জন্য গ্রাহকের কাছে ডলার বিক্রির দর, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করার জন্য বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে দেয়া দর এবং নেট ওপেন পজিশন লিমিট (এনওপি) বা প্রতিদিন লেনদেন শুরুর সময় ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। এই ৩টি তথ্য দিয়েই বাজারের ওপর নজরদারি জোরদার করবে। সূত্র মানব জমিন

আরও খবর: অর্থনীতি