জাতীয়

সাতক্ষীরা – ৪ ‘রাজা ইলেকশনে’ আলোচনায় নোঙ্গর বনাম নৌকা, প্রতিশ্রুতি, ভোটের পরে ফস করেনা!

  প্রতিনিধি ৪ জানুয়ারি ২০২৪ , ৫:৫১:৩১ প্রিন্ট সংস্করণ

সূত্র বিবিসি বাংলা

সাতক্ষীরা শহর থেকে সড়ক পথে দেড় ঘণ্টা গেলেই শ্যামনগর উপজেলা। উপজেলায় ঢুকতে রাস্তার দুই ধারে চোখে পড়ে ছোট-বড় অসংখ্য চিংড়ি ঘের। অথচ কয়েক বছর আগেও সেখানে ফসলের ক্ষেত ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

মূলত: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে, সাতক্ষীরা-৪ আসনের শ্যামনগর এবং কালিগঞ্জ উপজেলা সেগুলোর অন্যতম।

সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছরই একটু একটু করে লবণাক্ততা বাড়ছে এখানকার মাটিতে।

এতে গোটা এলাকায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

 

লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায়

 

আলোচনায় নোঙ্গর বনাম নৌকা

সুন্দরবনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যামনগর উপজেলার পুরোটা এবং পার্শ্ববর্তী কালিগঞ্জ উপজেলার একটি অংশ নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-৪ আসন।

আসনটিতে দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট সাত জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ভোটের মূল লড়াইটা হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) মধ্যে।

বিএনএমের প্রার্থী এইচ এম গোলাম রেজা এখানে বেশ আলোচনায় রয়েছেন। তাকে নিয়ে এতো আলোচনার মূলেই রয়েছে তার বিশেষ নির্বাচনী কৌশল, যার মাধ্যমে তিনি একই সাথে বিএনপি-জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের ভোট পেতে চাচ্ছেন।

মিস্টার রেজা এরআগেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে ভোটে জিতেছিলেন।

অবশ্য তখন তিনি জাতীয়পার্টির রাজনীতি করতেন। পরে দলের তৎকালীন চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সাথে দ্বন্দ্বের জেরে জাতীয় পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

এরপর মিস্টার রেজা প্রথমে বিকল্পধারায় যোগদান করলেও এবার নির্বাচন করছেন বিএনএমের নোঙ্গর প্রতীকে।

এই নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন নৌকার প্রার্থী এসএম আতাউল হক দোলন। তিনি শ্যামনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।

তাকে পরাজিত করতে বিএনএম প্রার্থী মিস্টার রেজা এবার একদিকে যেমন বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের কাছে টানছেন, তেমনি আওয়ামী লীগের ভোটব্যাঙ্কেও ভাগ বসাতে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন মহাজোটের অন্যতম সদস্য হিসেবে।

নতুন এই কৌশলে ভোটারদের কাছ থেকে বেশ সাড়াও পাচ্ছেন মিস্টার রেজা। ফলে আগামী নির্বাচনে নোঙ্গরের শক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত নৌকা আটকে যায় কি-না, সেটা নিয়েই এখন ভোটারদের মাঝে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে।

 

সাতক্ষীরা-৪ আসনে বেশ আলোচনায় রয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) প্রার্থী এইচ এম গোলাম রেজা

যত প্রতিশ্রুতি: ইস্যু পরিবেশ এবং জলবায়ু

সাতক্ষীরা-৪ আসনে এবার যে সাত জন প্রার্থী নির্বাচন করছেন, তাদের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে যাচ্ছে আসলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম আতাউল হক দোলন এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) এইচ এম গোলাম রেজার মধ্যে।

ফলে প্রচার-প্রচারণাতেও তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় সভা-সমাবেশ করছেন তারা।

এক্ষেত্রে দু’জনই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

“টেকসই বেড়িবাঁধ, সুপেয় পানি এবং লবণাক্ত পরিত্যক্ত জমিকে ফসলি জমিতে রূপান্তর করাই আমার প্রধান লক্ষ্য”, বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম আতাউল হক দোলন।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রচেষ্টার কারণেই এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। আমি সংসদে গেলে বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব সহকারে উচ্চমহলের কাছে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো যেন এই এলাকার মানুষের ভালো হয়।”

লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমি নষ্ট হওয়ায় আসনটিতে অনেক লোক বেকার হয়ে পড়েছে।

তাই বেকারত্বের সমাধানের ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) এইচ এম গোলাম রেজা।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমি ক্ষমতায় গেলে টেকসই বেড়িবাঁধ ও খাবার পানির ব্যবস্থা করার পাশাপাশি প্রতিটি ইউনিয়নে এক হাজার করে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো।”

 

 

এই দুই প্রার্থীর বাইরে জাতীয় পার্টির মাহবুবুর রহমান, তৃণমূল বিএনপির আসলাম আল মেহেদী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের শফিকুল ইসলাম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির শেখ ইকরামুল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান এই আসনে নির্বাচন করছেন।

তবে কিছু ব্যানার- পোস্টার টানানোর বাইরে তাদের তেমন কোন নির্বাচনী তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

‘রাজা ইলেকশনে’ ভোটের কৌশল

জাতীয় নির্বাচনকে শ্যামনগর-কালিগঞ্জের সাধারণ মানুষ চেনে ‘রাজা ইলেকশন’ হিসেবে।

তাই রাজার আসনে বসতে আসনের মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এখন নানান ছক কষছেন।

এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কৌশল হচ্ছে, নিজেদের ঐক্য বজায় রেখে ভোটে জয়লাভ করা।

মূলত: এই কৌশলের কারণেই আসনের গত দুইবারের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার এবার সুযোগ থাকার পরও স্বতন্ত্রপ্রার্থী হননি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

“আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি। এখন কেউ আমাদের পরাজিত করতে পারবেনা না”, বিবিসি বাংলাকে বলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম আতাউল হক দোলন।

তিনি আরও বলেন, “বিগত আমলে আমরা যেভাবে উন্নয়নমূলক কাজ করেছি, সেগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই মানুষ আমাদের আবারও নির্বাচিত করবে।”

অন্যদিকে, ভোটে জিততে সবদলের ভোটার টানার কৌশল নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) এইচ এম গোলাম রেজা।

সাতক্ষীরার এই আসনটি বিএনপি-জামায়াতের অন্যতম ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত।

কাজেই এই ভোটব্যাঙ্ককে নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে মিস্টার রেজা বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন।

বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের যেন মামলা-হামলা ছাড়াই এলাকায় অবস্থান করতে পারে, সে ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন তিনি।

“এই নির্বাচনে আমি যখন এসেছিলাম, তখন (সরকারকে) একটাই শর্ত দিয়েছিলাম। আর সেটি হচ্ছে, আমার জনগণের নিরাপত্তা দিতে হবে। গায়েবি মামলা থেকে তাদের মুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে দল-পার্টি কিছুই আমি দেখতে চাই না,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মিস্টার রেজা।

সাতক্ষীরা-৪ আসনে এবার নির্বাচনী প্রচারণায় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রার্থীরা

এই কৌশলে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের কাছ থেকে বেশ সাড়া পাচ্ছেন বলেন বিবিসিকে জানান বিএনএমের এই প্রার্থী।

“দল-মত-নির্বিশেষে এখানকার মানুষ আমাকে কতটা চায়, আগামী সাত তারিখ আসলেই সেটা বুঝতে পারবেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত- সবাই আমাকে ভোট দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।”, বিবিসি বাংলাকে বলেন এইচ এম গোলাম রেজা।

আওয়ামী লীগের ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে বিভিন্ন ব্যানার পোস্টারে নিজেকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন মহাজোটের অন্যতম সদস্য হিসেবে, যা নিয়ে আপত্তি তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম আতাউল হক দোলন অভিযোগ করেন, “মহাজোটগত ভাবে এবার কোন নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু প্রতিটি পোস্টার-ব্যানারে উনি নিজেকে মহাজোটের অন্যতম সদস্য বলে দাবি করছেন! এভাবে উনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।”

এ ব্যাপারে বিএনএম প্রার্থী মি. রেজার ব্যাখ্যা এরকম, “এই নির্বাচনে কোন বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচনে আসে নাই। কাজেই এরপর যত দল ভোটে এসেছে, তারা সবাই মহাজোটের অংশীদার। যারা এগুলো বলছে, তাদের মহাজোট সম্পর্কে কোন ধারণা নেই।”

‘ভোটের পরে ফস্ করেনা’

নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রার্থীরা নানান প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোটাররা সেগুলোকে খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না। কারণ এ ব্যাপারে তাদের অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না।

“ইলেকশনের আগে এসে এ দেবো, ও দেবো কয়, কিন্তু ভোটের পরে আর ফস করে না”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আমেনা বেগম।

নির্বাচন ইস্যুতে ‘ভোটের পরে ফস করেনা’ বাক্যটি এখানে বহুল প্রচলিত এবং বেশ জনপ্রিয়।

এর পেছনের ঘটনা জানতে চাইলে স্থানীয় একজন প্রবীণ ভোটার হোসেন আলী সর্দার বিবিসি বাংলাকে বলেন, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে নির্বাচনের দিন এখানে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভোটারদের কোলা (কোমল পানীয়) খাওয়ানো হতো যেন ভোটটা তারাই পায়।

তখন ভোট দেওয়ার আগেই একবার কোলা খাওয়ানো হতো এবং প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো যে, ভোট শেষে আরও এক বোতল কোলা দেওয়া হবে।

এ ধরণের পানীয় এখানে নতুন এবং বেশ মজার। কাজেই ভোটাররা তার পক্ষেই ভোট দিতো।

কিন্তু ভোট দেওয়া যখন আবারও কোলা চাওয়া হলে দেওয়া হতো সাধারণ পানি। কোলার নাম না জানা থাকায় ভোটাররা বলতো ‘ফস’ করে ওঠে যে পানি, সেটা দেন।

তখন প্রার্থীদের পক্ষ থেকে জবাব আসতো “ভোটের পরে আর ফস করে না।” অর্থাৎ ভোট দেওয়ার পর তোমার আর কোন দাম নেই।

 

 

ভোট চাইতে এসে প্রার্থীরা স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সালমা খাতুন বিবিসি বাংলাকে বলেন,

“নির্বাচন যতদিন না হবেনে, ততদিন তোমার ঘরের দোরে (দুয়ারে) আসপেনে। কিন্তু ভোট শেষ হয়ে গিলি কাউরে আর খুঁজে পাওয়া যাবেন না। তখন নিজেরাই ডুবে মরবানে।”

এরপরও তিনি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন যে, কোন একজন প্রার্থী হয়তো একদিন নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করে সেখানে একটি স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিবে।

 

‘এবার কি ভোট দিতি পারবো?’

ভোট নিয়ে প্রার্থীদের এতোসব তোড়জোড়, সমীকরণ এবং কৌশল শেষ পর্যন্ত কতটা কাজে আসবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।

কেননা, সাতক্ষীরার সাধারণ ভোটারদের একটি বড় অংশের মধ্যে এখনও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনে না থাকাটা যেমন এই দ্বিধার একটি কারণ, তেমনি কেন্দ্রে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোট দিতে পারবেন কি-না, তাদের মধ্যে সে অনিশ্চয়তাও কাজ করছে।

“২০১৪ সালে তো ভোট দিয়া লাগিনি। আর গতবার কেন্দ্রে ঢুকে শুনি ভোট দিয়া হয়ে গেছে”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মধ্যবয়সী ইমাম হোসেন।

কাজেই এবার ভোট দিতে পারবেন কি-না, তা নিয়ে বেশ অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তিনি।

“ভোট দিতি তো অসুবিধে নেই। কিন্তু কেন্দ্রে গেলি এবার কি ভোট দিতি পারবো?”, বলেন মি. হোসেন।

অন্যদিকে, আগামী নির্বাচনকে “সাজানো নির্বাচন” হিসেবে বর্ণনা করে স্থানীয় আরেকজন ভোটার মো. আসাদুজ্জামান বিবিসিকে বলেন, তিনি ভোট দিতে খুব একটা আগ্রহী নন।

“আমরা কি কিছুই বুঝিনা? যা দেখতে পাচ্ছি, তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, নির্বাচন আবারও একতরফা হতি যাচ্ছে। এটা সাজানো নির্বাচন।”

 

আরও খবর: জাতীয়