অর্থনীতি

সস্তায় বিদেশি ঋণ এখন গলার কাঁটা

  সূত্র সমকাল ২৩ জুলাই ২০২৩ , ৩:১৮:২৩ প্রিন্ট সংস্করণ

 

 

 

করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণে বিশ্ববাজারে ঋণের সুদহার শূন্যের কাছাকাছি নামে। হুন্ডি বন্ধ থাকায় ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ২৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। রপ্তানি বাড়ে ১৫ শতাংশের ওপরে। বেশির ভাগ দেশে তহবিল পড়ে ছিল। অথচ বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ওই সময়েই স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ বাড়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সস্তায় নেওয়া এসব বিদেশি ঋণ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানি ব্যাপক কমানো এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির পরও স্বস্তি ফিরছে না ডলার বাজারে। কারণ, বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ পরিশোধের বড় ধরনের চাপ রয়েছে।

ব্যাংক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলার সংকটের পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের জন্য খরচও অনেক বেড়েছে। গত বছরের শুরুতে প্রতি ডলার পাওয়া যেত ৮৬ টাকায়। এখন ১ ডলার কিনতে খরচ হচ্ছে অন্তত ১০৯ টাকা। এর মানে, শুধু বিনিময় হারজনিত কারণে প্রতি ডলারে বাড়তি গুনতে হচ্ছে ২৩ টাকা। সুদহারও কয়েক গুণ বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে গত বছরের শুরুতে সব ধরনের খরচসহ স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল ৩ শতাংশের কম। এখন সেই ঋণে সুদ গুনতে হচ্ছে ৯ শতাংশের বেশি। আবার বিনিময় হার বা সুদহার এ পর্যায়ে স্থিতিশীল থাকবে কিনা তা কেউ বলতে পারছে না। অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনায় বিদেশি ঋণের খরচ বেশি হওয়ায় একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশি ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডিস সম্প্রতি বাংলাদেশের কান্ট্রি রেটিং কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বেশি সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়াও এখন কঠিন হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অনেক ব্যাংক বাংলাদেশি কোনো কোনো ব্যাংকের ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা কমিয়েছে। এতে করে একদিকে নতুন ঋণ কম আসছে, অন্যদিকে আগের পরিশোধ বেড়ে গেছে। ডলারের বাজারে যা এখন প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, করোনার শুরুর দিকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা ছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক কমে যায়। ওই সময়ে ডলারের প্রয়োজনীয়তাও কমে যায়। অনেক দেশ তখন ঋণ পরিশোধ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে উল্টোটি। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তার মাধ্যমে ঋণের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ঋণ পরিশোধের শর্ত শিথিল করে। কম সুদ এবং সহজ শর্তের কারণে ব্যবসায়ীরাও বিদেশ থেকে প্রচুর ঋণ নিতে থাকেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন বাজার থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়িয়েছে।

করোনা শুরুর আগে ২০২০ সালের প্রথম দিকে ৩২ বিলিয়নে থাকা রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় এখন আগে নেওয়া ঋণ পরিশোধের ব্যাপক চাপ তৈরি হয়েছে। অথচ সেভাবে নতুন ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে বাজারে অস্থিরতা কাটছে না।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনার সময়ে বিনিয়োগ চাহিদা কমায় বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক কম ছিল। ডলারের বিনিময় হার দীর্ঘদিন একই জায়গায় স্থিতিশীল রাখা হয়েছিল। যে কারণে উদ্যোক্তারা তখন অভ্যন্তরীণ উৎসের তুলনায় বিদেশ থেকে বেশি ঋণ নিয়েছেন। এখন সুদহার ও বিনিময় হার অনেক বেড়েছে। এর মধ্যে মুডিস থেকে ঋণমান কমানোর ফলে বিদেশি ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে আমদানি কমার পরও ডলার বাজারে চাপ কমছে না। তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর আরও জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম করণীয় ডলার কেনাবেচার দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা। তাতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক খাতের প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এতে করে ডলারের দর আরও বেড়ে হয়তো ১১৩ থেকে ১১৪ টাকায় যাবে। তবে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়ে সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক না করলে সংকট থেকে বের হওয়া কঠিন হবে।

 

ব্যাংকাররা জানান, করোনার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। রপ্তানি আয় বেড়েছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। ওই সময় বিদেশি ঋণ আকর্ষণীয় হলেও তা ঠেকানোর কোনো চেষ্টা ছিল না। এর আগে কৃত্রিমভাবে ডলারের বিনিময় হার দীর্ঘদিন একই জায়গায় রাখা হয়েছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর কোনো অবস্থায় বিনিময় হার ৮৫ টাকায় ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। গত বছরের শুরুর দিকে বিনিময় হার আটকানোর চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আরও খবর: অর্থনীতি