সারাদেশ

রোগীকে ‘ঘুঘুর ফাঁদ’ দেখাচ্ছে দালাল, গুরুত্বপূর্ণ রোগী মানে ছক্কা!

  প্রতিনিধি ৮ মার্চ ২০২৪ , ৩:০৯:৪৯ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডে 

যেন রোগী ভাগানোর এক মচ্ছব! ফন্দি এঁটে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে রোগী পাঠানো, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের জন্য ফার্মেসি– সবই ‘নির্ধারিত’। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পা ফেললে রোগীকে দেখতে হয় এমন ‘ঘুঘুর ফাঁদ’। এ ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে শতাধিক দালাল। শুধু পুরুষ নয়, রোগীর ‘মন ভোলাতে’ আছে নারী দালালও। চট্টগ্রাম অঞ্চলের দরিদ্র ও অসহায় রোগী এবং তাদের স্বজনকে নানা প্রতিশ্রুতির চোরাবালিতে ফেলে এ চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। অনেক সময় দালালদের খামখেয়ালিপনায় মরণাপন্ন হয়ে পড়ছে রোগী। দিনের পর দিন হাসপাতালজুড়ে এমন দালালকাণ্ড চললেও যেন দেখার কেউ নেই। অভিযোগ রয়েছে, মূল কুশীলবকে ধরতে কার্যকর পদক্ষেপও নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

খোঁজখবর নিয়ে চমেক হাসপাতাল ঘিরে শতাধিক দালালের সক্রিয় উপস্থিতি পেয়েছে এই প্রতিবেদক। যাদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ৪০। চমেকের চারপাশের শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসি এসব দালালকে পালছে। রোগী ভাগানোর ওপর দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে কমিশন ঢোকে দালালের পকেটে। দালালদের ‘প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব’ তৈরি করতে দেওয়া হয় লোভনীয় টাকার প্রস্তাব। যেসব বিভাগে রোগীর আধিক্য, অস্ত্রোপচারের জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন হয়– রোগী ভাগাতে সেখানেই থাকে দালালদের চতুর চোখ।

রোগীকে ফাঁদে ফেলতে দুপুরের পরের সময়টি দালালদের বেশ পছন্দের। কারণ ওই সময় হাসপাতাল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাশূন্য হয়ে পড়ে। আইসিইউ ওয়ার্ড থেকে একজন রোগী ভাগিয়ে নিতে পারলেই দালালের হাতে চলে আসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।

হাসপাতালে রোগীর ভাগ্যে জোটে না ওষুধ। হরহামেশা হয় চুরি। হুটহাট নষ্ট হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ রোগ নির্ণয় যন্ত্র। ওষুধ চুরিসহ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত খোদ হাসপাতালের কর্মী-নার্স। অনিয়ম-হয়রানির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় গত দেড় বছরে অন্তত ১৫ কর্মীকে পুলিশে দেওয়া হয়। তবু কমেনি অরাজকতা।

হাসপাতাল ঘিরে শতাধিক দালাল

হাসপাতালটি বৃহত্তর চট্টগ্রামের দরিদ্র ও অসহায় রোগীর একমাত্র ভরসার চিকিৎসা কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে তিন হাজারের বেশি। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন আরও কয়েক হাজার। এত রোগীতে গমগম করায় দালালদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে হাসপাতালটি।

ওয়ার্ড ভাগ করে পালা করে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সক্রিয় থাকে দালালরা। রোগী ও তাদের স্বজনকে ফাঁদে ফেলতে সক্ষম– এমন তরুণ দালালদের মাঠে দায়িত্ব দেয় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান। সক্রিয় থাকা দালালদের নামও পেয়েছে এই প্রতিবেদক।

রোগী ভাগিয়ে নেওয়া ও হয়রানি করার সময় এদের অনেককেই একাধিকবার হাতেনাতে আটক করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ।

গুরুত্বপূর্ণ রোগী মানে ছক্কা!

আইসিইউ থেকে এক রোগী ভাগিয়ে আনতে পারলেই মেলে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা! এ কারণে ভুয়া ডাক্তার ঢুকিয়েও রোগী ভাগানোর চেষ্টা করে দালালচক্র। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি। রোগী ভাগিয়ে নিতে ডাক্তার সেজে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ঢোকেন তৈয়ব আলী পাটোয়ারী। তাঁর পরনে ছিল ডাক্তারের অ্যাপ্রোন। অথচ তিনি বেসরকারি চিটাগং ল্যাব লিমিটেডের টেকনিশিয়ান। মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব পেয়ে ভুয়া ডাক্তার সেজে আইসিইউ থেকে রোগী ভাগাতে এসেছিলেন তিনি। পরে হাতেনাতে আটক করে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

 

 

 

এ ব্যাপারে দুদকের সহকারী পরিচালক এনামুল হক বলেন, ‘এই হাসপাতালে দালালের উৎপাত সবচেয়ে বেশি। এখানে রোগীদের সরকারি ওষুধ সরবরাহ না করে আত্মসাৎ করা হয়। ওষুধ নিয়ে নয়ছয়ের প্রমাণ একাধিকবার পেয়েছি আমরা। এর নেপথ্যে রয়েছে হাসপাতালের নার্স, আয়া, ওয়ার্ডবয় ও কিছু কর্মচারী। দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্র নষ্ট থাকে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে ভূরিভূরি অনিয়ম, ভোগান্তি-হয়রানির প্রমাণ পেয়েছি।’

পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক বলেন, ‘দালাল ধরার পর দেশের প্রচলিত আইনে এ অপরাধের নির্দিষ্ট ধারা না থাকায় মামলা করার সুযোগ থাকে না। শুধু অভিযোগ দাখিল করে আদালতে পাঠানো হয়।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘দালাল চক্রের অত্যাচারে সবাই ত্যক্তবিরক্ত। তাদের কারণে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রোগী। হাসপাতালের চারপাশে থাকা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসি দালালদের পালে। অনেক সময় আইসিইউ থেকেও রোগী উধাও হয়ে যায়।

 

আরও খবর: সারাদেশ