জাতীয়

যে কারনে মুখ খোলেন না ছাত্রীরা, যৌন হয়রানির চাপা কষ্ট নিয়েই শেষ হয় উচ্চশিক্ষা!

  প্রতিনিধি ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৩:৩৯:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডে

 

উদার নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের জন্য ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। এক শ্রেণির শিক্ষক ও ছাত্রের যৌন নিপীড়নের ফলে এ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নিপীড়করা প্রভাবশালী হওয়ায় ভুক্তভোগী নারী শিক্ষক ও ছাত্রীরা তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করছেন না। এক গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নের শিকার ছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ এসব ঘটনায় অভিযোগ করেন। এ অভিযোগগুলোও নিষ্পত্তি করে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উলটো নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে শিক্ষাজীবনে নানা ক্ষতির সম্মুখীন হন অনেকে। শিক্ষকদের ভোটের রাজনীতি অভিযুক্তকে বাঁচাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বছরের পর বছর এমন অবস্থা চলতে থাকলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না। দীর্ঘ সময় ধরে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন প্রণয়নের দাবি উঠলেও তা করা হয়নি। এ অবস্থায় ক্যাম্পাসে নিপীড়ন বেড়েই চলছে।

দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৫ বছরের যৌন নিপীড়নের ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত ৫১টি যৌন হয়রানির অভিযোগ সামনে আসে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত সাতটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন অন্তত সাতটি ঘটনা ঘটেছে।

 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ অভিযোগই নিষ্পত্তি করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় গঠিত যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল বেশির ভাগ সময়ে সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয় না। আবার প্রতিবেদন দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণকারী ফোরামগুলোতে উপাচার্যরা তা উপস্থাপন করেন না। শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন অন্তত ৬-৭টি ঘটনা রয়েছে। যৌন হয়রানির অভিযোগ নিষ্পত্তিতে নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকার সুযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই কাজগুলো করছে। এভাবে বিচারপ্রার্থীরাও একসময় ক্যাম্পাস ছেড়ে যান। ফলে যৌন নিপীড়করাও একসময় পার পেয়ে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, এ ঘটনাগুলো প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। সব প্রতিষ্ঠানকে এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির একটি অভিযোগ নিষ্পত্তিতে আমরা ৩ মাস সময় বেঁধে দিয়েছি। এভাবে সময় বেঁধে দিতে হবে। তাছাড়া অভিযোগগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে করতে হবে। তা না হলে তদন্তেও বেগ পেতে হয়। আর অসম্পূর্ণ তদন্তে ব্যবস্থা নিলে পরে আদালতে তা টেকে না। তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ভুক্তভোগীদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবার সাংস্কৃতিক উন্নয়নে নজর দেওয়া জরুরি। এজন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, প্রথমবর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেব।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম তার বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংক্রান্ত অভিযোগ নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত স্নাতকোত্তর ও স্নাতকে অধ্যয়নরত ২০০ ছাত্রী ওই গবেষণায় অংশ নেন। গবেষণায় উঠে আসে, নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেছিলেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ যথাযথ নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে অভিযোগ করেছেন। বাকি ৫ শতাংশ অভিযোগ করেছেন বিভাগের শিক্ষক বা প্রক্টরের কাছে। ৫৬ শতাংশ নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ শতাংশ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষক। চরিত্র হনন ও ন্যায়বিচার না পাওয়ার ভয়ে ৯২ শতাংশ ছাত্রী সেলে অভিযোগ করেননি বলে গবেষণায় উঠে আসে।

এ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রী বলেন, ল্যাবে স্যার আমাকে অযাচিতভাবে স্পর্শ করেছিলেন। তাৎক্ষণিক ভাবে এর প্রতিবাদ করেছিলাম। ফলে ওইবারের পরীক্ষায় আমাকে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন মনে হচ্ছিল যেন মরে যাই। পরে যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় এজন্য বিষয়টি নিয়ে আর কাউকে কিছুই বলিনি। পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরি করছি। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আর কথা বলতে চাই না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলোয় জড়িতরা বেশ ক্ষমতাধর হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও ছাত্রীরা বিচার পান না। উলটো পদে পদে বাধা-বিঘ্ন, অসহযোগিতা করা হয়। যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলও বারবার আপত্তিকর, অসৌজন্যমূলক ও অপ্রাসঙ্গিক কথা জিজ্ঞেস করে পুনরায় হয়রানি করে। এই কমিটিগুলো প্রভাবশালী অভিযুক্তকে ভোটের কারণে, রাজনৈতিক কারণে খ্যাপাতে চায় না। সত্য প্রকাশ না করে নিপীড়ককে রক্ষা করে। অপরদিকে অভিযোগ করলে শিক্ষকরা পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে টিউটোরিয়াল, উত্তরপত্র এবং ভাইভায় নম্বর কম দেন। ফলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে ভয় পান। অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা না থাকায় তারা যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে। এ ঘটনাগুলোর বিচার নিশ্চিতে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পৃথক আইন প্রণয়ন জরুরি। কারণ বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলার কারণে অনেকেই পার পেয়ে যান।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের যৌন হয়রানি ছাড়াও ছাত্রদের যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে অহরহই। অধিকাংশ ঘটনায় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাদের নাম আসছে। দলীয় প্রভাব বিস্তার করে তারাও অনেক সময় অভিযোগগুলো থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন। পুরুষ সহকর্মীর দ্বারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেক নারী শিক্ষক। তারাও এসব নিয়ে অনেক সময় মুখ খুলতে পারছেন না।

আরও খবর: জাতীয়