জাতীয়

যে উপজেলায় গ্রামে গ্রামে সন্ত্রাসী বাহিনী, বড়লোকের পক্ষে পুলিশ-প্রশাসন!

  প্রতিনিধি ১৫ মার্চ ২০২৪ , ৪:৩২:২৭ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডে

রাজধানীর অদূরের জনপদ রূপগঞ্জ। এখানেই গড়ে উঠেছে রাজউকের পূর্বাচল উপশহর। রয়েছে চনপাড়া পুনর্বাসনকেন্দ্র। কাঁচপুর ব্রিজ থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের প্রায় ২০ কিলোমিটার রূপগঞ্জের অন্তর্গত। রূপগঞ্জকে শীতলক্ষ্যা নদী দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে রূপগঞ্জকে বালু নদী ভাগ করে রেখেছে। ঢাকার অদূরে ও পূর্বাচল উপশহরকে ঘিরে অবস্থিত হওয়ায় অর্ধশতাধিক আবাসন প্রকল্প রূপগঞ্জের জলাশয়, খাল-বিল, ফসলি জমি দখল করে রেখেছে। আবাসন প্রকল্পের কেউ কেউ সরকারি জমি দখল করছে। তারা নিয়োজিত করছে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের। আবাসন প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী অবৈধ কাজ বাস্তবায়নে গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রায়ই এসব সন্ত্রাসী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারে প্রতিনিয়ত যোগ দিচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতির ঘটনায় বাদীপক্ষ গরিব হলে পুলিশের ভূমিকা থাকে রহস্যজনক। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার ব্যবসা বাণিজ্য নিয়েও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। আবার নগদ ইনকাম ভালো থাকায় কিশোর ও যুবকরা মাদক সেবনে ঝুঁকছে। স্থানীয় একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা, ইউনিয়ন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। অপরাধের বৃহত অংশ শিল্পকারখানা ও হাউজিং প্রকল্পকেন্দ্রিক। অনেক সময় ভূমিদস্যুদের হাতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি জিম্মি হয়ে পড়ে।

 

হত্যাকাণ্ডের বিচার নেই

রূপগঞ্জের আলোচিত ঘটনাসহ অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের বিচার নেই। শিশু হত্যা, গৃহবধূ হত্যা, স্বামী হত্যা, শিক্ষার্থী হত্যা, রাজমিস্ত্রি হত্যা ছাড়াও গত ২০ বছরে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী খুন হয়েছে। এসব হত্যা মামলা বিচারাধীন। তবে একটিরও বিচার হয়নি। হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় হত্যাকাণ্ড ঘটছেই। হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে আছে। সন্ত্রাসীদের ভয়ে সাক্ষীরা সঠিক সাক্ষ্য দিচ্ছে না। দীর্ঘদিন বিচারের আশায় আদালতে ঘুরতে ঘুরতে বাদীপক্ষ মামলা চালাতে অপারগ হয়ে পড়ে। তাতে আইনের ফাঁক-ফোকরে অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যায়।

দুই মাসেও উদ্ধার হয়নি অপহূত ছাত্রী

এদিকে বাঘবের আইডিয়াল হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিলা আক্তার বাড়ি ফেরার পথে গত ১৫ জানুয়ারি অপহরণ হয়। তানজিলার বাবা দিনমজুর আব্দুল জব্বার বাদী হয়ে পাঁচ জনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তানজিলাকে উদ্ধারের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা তানজিলার বাবার কাছ থেকে কয়েক দফা গাড়ি ভাড়ার নাম করে টাকা নেন। কিন্তু গত ১৪ মার্চ পর্যন্ত মামলা হিসেবে রুজু হয়নি। কেউ গ্রেফতার কিংবা তানজিলাকে উদ্ধারও করা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা ছাড়া রূপগঞ্জ থানায় কাজ হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বৃদ্ধি

রূপগঞ্জের ভুলতা, গোলাকান্দাইল, কাঞ্চন, দাউদপুর, রূপগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তারা মাদক কেনাবেচা, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, নারী নির্যাতন, মাদক সেবন, হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। গোলাকান্দাইলের স্যাভেজ গ্যাং ও ডেঞ্জার গ্রুপ আতঙ্কের নাম। গোলাকান্দাইলের সাজ্জাত, সাদেক, রবিউল, আমিনুল, আরমান কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের নেতা শাওনের নামে রূপগঞ্জ ও ভৈরবসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ১৩টি মামলা রয়েছে। ভুলতার বায়েজিদের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ৭০।

কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রতিটি এলাকায় ফিল্মিস্টাইলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে বয়সে কিশোরদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার কথা, খেলার মাঠে থাকার কথা সে বয়সে তরুণরা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। নেশার টাকা যোগাতে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে তারা জড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে কিশোর গ্যাং সদস্যদের সেল্টার দিচ্ছে। জমি দখল, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নতুন ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে কৌশলে টাকা আদায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে আড্ডা, নারীদের উদ্দেশ্য করে অশালীন মন্তব্য, গার্মেন্টস কর্মীদের উত্ত্যক্তসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িয়ে পড়ছে।

 

অবৈধ দখলে সরকারি জমি:

উপজেলার মুড়াপাড়া, তারাব, ভুলাতা, গোলাকান্দাইল, দাউদপুর, ভোলাবসহ আশপাশের বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি বেদখল রয়েছে। আবাসন প্রকল্প, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও সন্ত্রাসীরা এ সকল জমি দখল করে রেখেছে। উপজেলা প্রশাসনও অবৈধ বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে তৎপর রয়েছে।

 

শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল

শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরের স্থানে স্থানে বেদখল হয়ে গেছে। বাড়ির মালিক থেকে শুরু করে শিল্পকারখানার মালিকরা নদী দখলে এখন সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীর গভীর পর্যন্ত জেটি তৈরি করে দখলে নিয়ে মালামাল লোড-আনলোড করছে। নদী দখলে বিপন্ন হয়ে গেছে পরিবেশ। কোনো কোনো স্থানে মাছের ঘের দিয়ে নদী দখল করা হচ্ছে। নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করা হলেও কিছুদিন পরে আবারও নদী বেদখল হয়ে যায়।

দুই শতাধিক মাদকের স্পট

গোলাকান্দাইল ৫ নম্বর ক্যানেল, মুড়াপাড়া, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র, ভায়েলা বেবির বাড়ি, ভুলতা, দাউদপুর এলাকা এখন মাদকে সয়লাব। উপজেলার অন্তত দুই শতাধিক স্পটে মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে।

ফুটপাত অবৈধ দখলে

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুই পাশে ভুলতা গাউছিয়া মার্কেটের সামনের ফুটপাত অবৈধ দখলে রয়েছে। সাত শতাধিক অস্থায়ী দোকানদার তাদের পণ্য নিয়ে মহাসড়কের দুই পাশ দখলে নেয়। সুযোগ পেয়ে স্থানীয় কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা এ সকল দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদার টাকা ওঠায়। প্রতিটি দোকান থেকে এককালীন ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা জামানত আদায় করা হয়।

নৌ পরিবহনে চাঁদাবাজি

শীতলক্ষ্যা নদীর রূপগঞ্জ অংশের বিভিন্ন স্থানে নৌ পরিবহন থেকে নৌ পুলিশের নামে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অটোরিকশায় চাঁদাবাজি

রূপগঞ্জের অভ্যন্তরীণ সড়কের অটোরিকশার চালকেরা চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। অটোরিকশায় স্টিকার ব্যবহার করে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করা হচ্ছে।

ইটের ভাটায় যত অনিয়ম

রূপগঞ্জের ইট ভাটাগুলোতে অনিয়মের অন্ত নেই। ফসলি জমি গভীর করে কেটে ইটভাটায় মাটি নেওয়া হচ্ছে। পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। শিশু শ্রমে চলছে ইটভাটা। নারী শ্রমিকদের মজুরি কম দেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো শ্রমিকদের আটকিয়ে রেখে কাজ আদায় করা হচ্ছে।

এমপি যা বললেন:

নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক বলেন, অপরাধীরা যে দলেরই হোক ছাড় দেওয়া হবে না। ভূমিদস্যুসহ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। অপরাধ কর্মকাণ্ড নির্মূলে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, ফুটপাত, নদী ও সরকারি জমি দখলদারীদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

রূপগঞ্জ থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা পুলিশের বিরুদ্ধে করা বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যা, মাদক ব্যবসাসহ সব অপরাধ নির্মূলে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

আরও খবর: জাতীয়