রাজনীতি

বিএনপির মাথায় বহু চ্যালেঞ্জের বোঝা

  প্রতিনিধি ১১ অক্টোবর ২০২৩ , ৩:২৯:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে দেড় দশক ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে বিএনপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকের অনেকে মনে করেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একদফার চলমান আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়া। কারণ, আন্দোলনের ফলাফলের ওপর আগামী নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ নির্ভর করছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির অনেক নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বলেও মনে করা হচ্ছে। অনেকের শঙ্কা, আন্দোলনে সফল হতে না পারলে বিভিন্ন মামলায় অনেক নেতার সাজা হয়ে যাবে। এরই মধ্যে রায় হওয়া বেশ কিছু মামলায় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাজা হয়েছে। এর ফলে জেলখানা হবে তাদের ঠিকানা। এ অবস্থায় চলমান আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করেই নির্বাচন করতে চায় বিএনপি। তবে আন্দোলনে সফল না হলে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পদক্ষেপ কী হবে—সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।

দলটির নেতারা বলছেন, চলমান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ বিএনপি। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আন্দোলনের সফলতা নিয়ে আশাবাদী তারা। আর বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের অনেকে মনে করেন, সরকার বিএনপিকে বাইরে রেখে ছোট দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করে ফেললেও এবার তা আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে বৈধতা পাবে না। ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারকে আলোচনায় বসতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিএনপি সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে। সাধারণ মানুষ এরই মধ্যে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। তারা এই সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সুতরাং আন্দোলনের সফলতা নিয়ে দেশবাসীর সঙ্গে আমরাও আশাবাদী।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কখন কী করতে হবে—সেটা সময়ই বলে দেবে।’

গত ১২ জুলাই থেকে একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এই আন্দোলনে প্রায় অর্ধশত দল সম্পৃক্ত হয়েছে। আগামী ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি রয়েছে দলটির। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। শারদীয় দুর্গাপূজার আগে ১৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জনসমাবেশ থেকে একদফা মানতে সরকারকে চূড়ান্ত আলটিমেটাম দিতে পারে বিএনপি। দাবি না মানলে ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টার ওই আলটিমেটাম শেষে অক্টোবরের শেষ দিকে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। বিএনপি ও যুগপতের নেতারা জানিয়েছেন, শারদীয় দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন করতে পূজা চলাকালীন বড় কোনো কর্মসূচি রাখবে না তারা।

এদিকে গুরুতর অসুস্থ খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে পরিবারের আবেদন সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর বাতিল করেছে সরকার। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে সরকার খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে।

বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলছেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিনিময়ে বিএনপিকে নির্বাচনে যাওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। তবে শর্ত মেনে খালেদা জিয়া কোথাও যাবেন না বলে দলটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে।

খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার আর কোনো চিকিৎসা অবশিষ্ট নেই। তাকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে নিয়ে লিভার

ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে, যা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা বিএনপির জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অনেকে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে চলমান একদফার আন্দোলন সফল করা বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এবার আন্দোলনের সফলতার ব্যাপারে আশাবাদী বিএনপির হাইকমান্ড। তারা বলছেন, আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ অব্যাহত রয়েছে। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক অবস্থা বিরাজ করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক বিশ্ব সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেই কাজ শেষ করছে না, তারা অ্যাকশনেও যাচ্ছে। স্যাংশন দিচ্ছে, ভিসা নীতি প্রয়োগ করছে, মেসেজ দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।’

আমীর খসরু দাবি করেন, ‘জনগণ এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে—এই সরকারকে তারা আর ক্ষমতায় রাখবে না। আর জনগণ যখন একবার সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সেটা বাস্তবায়ন করে। অতীতে একাধিকবার সেটা দেখা গেছে।’

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গণমাধ্যমকে বলেন, বিএনপি বারবার জনগণের ভালোবাসা-শুভেচ্ছায়, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় গেছে এবং জনকল্যাণে কাজ করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করেনি, রাষ্ট্রক্ষমতা দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করেনি। বিএনপি গণমানুষের দল, জনগণই বিএনপির ক্ষমতার উৎস। জনগণের ভালোবাসার ওপর ভর করে সব চ্যালেঞ্জ, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমরা সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের লক্ষ্য, জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে তাদের ভোট দিতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। সেজন্য এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগও সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) জানিয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী সঠিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যারা আসবে তাদের নিয়েই নির্বাচন হবে। নভেম্বরের প্রথম দিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার কথা জানিয়েছে ইসি। এমন প্রেক্ষাপটে চলমান আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না এলে বিএনপি কী করবে—সেই প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা কি ২০১৮ সালের মতো শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেবে, নাকি ২০১৪ সালের মতো আবারও নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটবে?

বিএনপির দাবি, তারা ভোট বর্জন করলে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোও তাদের অনুসরণ করবে। এ ছাড়া যুগপতে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা কয়েকটি দলও নির্বাচন বর্জন করবে বলে তাদের আশা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন বর্জন করলেও যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে নিবন্ধিত অনেক রাজনৈতিক দল ভোটে যাবে। এ লক্ষ্যে তারা প্রস্তুতিও নিচ্ছে। বেশকিছু দল নিয়ে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করলেও বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে এখনো তাতে সম্পৃক্ত করতে পারেনি বিএনপি। এ ছাড়া সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের বেশকিছু নেতাও তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। যদিও মার্কিন ভিসা নীতি আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার কারণে তারা কিছুটা দ্বিধায় রয়েছেন। সে কারণে এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। এ ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে নিবন্ধিত কয়েকটি দলও। এসব দলের নেতারাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আগামীতে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে তারা। সামনে আরও পদক্ষেপ আসতে পারে। সুতরাং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা এবার অত্যন্ত কঠিন হবে।

আরও খবর: রাজনীতি