জাতীয়

বড় ভুলে ছোট শাস্তি

  ঢাকা অফিসঃ ২৪ জুন ২০২৩ , ৫:১৬:৫০ প্রিন্ট সংস্করণ

 

চিকিৎসায় ভুল ও অবহেলার অভিযোগ দেশে নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে ‘ভুল চিকিৎসায়’ মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় এ বিষয়ে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়। সমালোচনার মুখে নড়েচড়ে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তৎপরতা বাড়িয়েছে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)।

চিকিৎসায় ভুল কিংবা অবহেলার কারণে মৃত্যুর ঘটনা তো ঘটছেই, আবার যারা বেঁচে থাকছেন, তারা স্বাস্থ্যগত নানা জটিলতায় ভুগছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, অধিকাংশ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) আসা এসব অভিযোগের সিংহভাগই ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকের অবহেলাজনিত। তবে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ হলেও বিচারে ধীরগতি দেখা গেছে। বড় একটি অংশের তদন্ত মাঝপথেই থেমে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের তদবির আর আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। কোনোটি তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে সমঝোতা হচ্ছে।

বিএমডিসির নিয়ম অনুযায়ী, অভিযোগের সত্যতা মিললে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী স্থায়ীভাবে নিবন্ধন হারাতে পারেন চিকিৎসক। তবে দেশের ইতিহাসে চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগ প্রমাণিত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসকের স্থায়ী নিবন্ধন বাতিলের নজির নেই।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান আইনেও চিকিৎসায় অবহেলার শাস্তি যথেষ্ট। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের অনীহায় ভুক্তভোগীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে।

আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতির পাশাপাশি অবকাঠামো দুর্বলতা প্রকট। সরকারের সদিচ্ছা জরুরি বলেও মত ব্যক্ত করেন তারা।

ভুল চিকিৎসার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এখন পর্যন্ত যেসব চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের একজন রাজধানীর সাহাব উদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কুররাতুল আইনুল ফরহাদ।

আট বছর আগে রাজধানীর বাড্ডার এক প্রসূতির অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে মারা যায় নবজাতক। এ ঘটনায় ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনে ভুক্তভোগীর পরিবার। দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত করে অবহেলার প্রমাণ পায় বিএমডিসি। পরে ২০১৮ সালে ওই চিকিৎসকের ছয় মাসের জন্য নিবন্ধন স্থগিত রাখা হয়।

অস্ত্রোপচারে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মাত্র এক বছরের জন্য নিবন্ধন স্থগিত করা হয় গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার আমরাইদ জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মো. জাহিদ ইসলামের।

নিজ বাসায় বেআইনি ভাবে ক্লিনিক খুলে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন অরুণ জ্যোতি চাকমা। অপেশাদার লোক দিয়ে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই পিত্তথলির (গলব্লাডার) অস্ত্রোপচারের ফলে মারা যান কুমিল্লা ইয়াংম্যান বুড্ডিটেস্টের সভাপতি শীল ভদ্র ভিক্ষু।

১৯৯৩ সালের এ ঘটনায় দীর্ঘ তদন্তের পর ওই চিকিৎসকের নিবন্ধন শুরুতে স্থায়ীভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বছর ঘুরতেই মাফ পেয়ে যান তিনি। ফিরিয়ে দেওয়া হয় নিবন্ধন। যদিও তিনি আর এ পেশায় ফেরেননি। তবে অন্য দুই চিকিৎসক আগের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা দিচ্ছেন।

অন্যদিকে বাম কানের সমস্যায় ডান কানের অস্ত্রোপচার করে এক বছরের জন্য নিবন্ধন হারিয়েছেন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অধ্যাপক ডা. আলী জাহীর আল-আমীন। ২০২০ সালের মার্চের ওই ঘটনায় দুই বছর তদন্ত শেষে গত বছরের নভেম্বরে মামলার নিষ্পত্তি হয়।

নিষ্পত্তি হওয়া অভিযোগগুলোর মধ্যে অর্ধেকই প্রমাণিত হয়েছে। তার পরও শাস্তি হিসেবে ১২ জনকে সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য নিবন্ধন স্থগিত রাখা হয়। তিনটি মীমাংসার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। বাকি ১৯টি প্রমাণিত হয়নি বলে জানিয়েছে বিএমডিসি।

বিএমডিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ‘একটা ঘটনায় চিকিৎসকের স্থায়ী নিবন্ধন বাতিল করা যায় না। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হয়ে থাকে। চিকিৎসকের এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? আমরা তো আর আইনের বাইরে যেতে পারি না।’

বিচার প্রক্রিয়ায় বিএমডিসির সক্ষমতার ঘাটতি আছে কিনা জানতে চাইলে লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়। নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এক থেকে অন্তত দুই বছর লেগে যায়। হঠাৎ করে তো আর লোকবল বাড়ানো কিংবা কমিটির সদস্য বাড়াতে পারব না। এখানে লোক বাড়াতে গেলে পদ সৃষ্টি করতে হবে। সেটা হয়তো ভবিষ্যতে হবে।’

তবে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণের পরও লঘু শাস্তি বিএমডিসির বড় দুর্বলতা বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য ও রোগতত্ত্ববিদ ড. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাতে ভুক্তভোগীরা কাক্সিক্ষত প্রতিকার পাননি। কারণ প্রাণহানির ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পরও যখন কারও বিরুদ্ধে স্থায়ীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, সেখানে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যারা দায়িত্বে আছেন, তারা ভয় পান বলেই বড় ভুলের এমন ছোট শাস্তি হচ্ছে।’

আরও খবর: জাতীয়