সারাদেশ

খোলপেটুয়া নদী পাড়ের মানুষের হাহাকার, জ্বলছে না চুলা, পানিতে তলিয়ে ১০ গ্রাম

  প্রতিনিধি ১৬ জুলাই ২০২২ , ৬:১৭:১৫ প্রিন্ট সংস্করণ

 

নীলাকাশ টুডেঃ সাতক্ষীরার খোলপেটুয়া নদী পাড়ের মানুষের কান্না কিছুতেই থামছে না। চারিদিকে পানি আর পানি। এক চিলতে মাটিও নেই। চুলা জ্বলছে না। মাটি খুঁড়লেই পানি বেরিয়ে আসছে।

খোলপেটুয়া নদী ভাঙ্গনে বিপর্যস্ত বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম দুর্গাবাটি গ্রামের হতদরিদ্র মলিনা রপ্তান, জোসনা সরকার, অনিমা সরকারের রান্নাঘরের চুলা পানির তলায়। উঁচু করে চুলো বানিয়ে সারছেন রান্নার কাজ। অতিকষ্টে রান্না করতে পারেন মাত্র একবেলা। জ্বালানির অভাবে যেদিন সে সুযোগটুকুও থাকে না, সেদিনের খাবার চিড়া-মুড়ি। ঘরের পাশেই পানির কল ডুবে আছে।

পানি কিছুটা কমে গেলে কলের পানিতেই সারতে হয় গোসলসহ অন্যান্য কাজ। ঘরের ভেতরে খাটের ওপরে রেখেছেন আরেকটি খাট। তার ওপরে কোনোমতে রাত পার করছেন। সারাদিন কাটছে পানিতেই; শুধু ঘুমানোর সময়টুকু শুকনোয়। খাট থেকে নামার পর থেকে সবখানেই পানি আর পানি।

এ চিত্র সাতক্ষীরা শ্যামনগর সদর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম দুর্গাবাটি গ্রামে। আকস্মিক নদী ভাঙ্গন এলাকার মানুষের জীবন লবণ পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। ইউনিয়নের গ্রামগঞ্জ, বাড়িঘর, স্কুল, ইট বিছানো রাস্তা সবকিছু পানির তলায়। দিনে দু’বার জোয়ারের পানিতে ভাসছে জনপদ। গতকাল নয়টি গ্রামের উপর দিয়ে জোয়ার ভাটা বয়ে গেলেও আজকে আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন ছাপিয়ে এখন পার্শ্ববর্তী আটুলিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে খোলপেটুয়া নদীর লোনা পানির জোয়ার ভাটা বইছে।

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে কুড়িটি গ্রামের মধ্যে এগারোটি গ্রাম পানিতে ভাসছে। নতুন করে আটুলিয়া ইউনিয়নের হেনচি, ছোটকুপট, সাপেরদুনে ও তালবাড়িয়া এলাকায় পানি ঢুকছে । স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা জানান, আজ দুপুর তিনটে পর্যন্ত যখন জোয়ার চলছিল চারিদিকে মনে হচ্ছিল যেন মহাসাগর। মাটির ঘরবাড়ি এবং সেমি পাকা ঘরগুলো কোন মতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে খোলপেটুয়া নদীর লোনাপানির সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। মাটির ঘরগুলি আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। পানীয় জলের সংকট চরম আকার ধারণ করছে। বর্তমানে কুড়ি হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। অনেকেই বাড়ি ঘরের মায়া ত্যাগ করে সাইক্লোন শেল্টার আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছেন।জোয়ারের তীব্রতা বেড়েই চলেছে তার সাথে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।

উল্লেখ্য খোলপেটুয়া নদী তীরবর্তী উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে শ্যামনগর উপজেলার দুই ইউনিয়নের ১৪ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ৫ নম্বর পোল্ডারের দুর্গাবাটি সাইক্লোন শেল্টারের পার্শ্ববর্তী বাঁধের প্রায় দেড় শ ফুট নদীতে ধসে পড়লে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে দুর্গাবাটি ও পোড়াকাটলা গ্রামের কিছু অংশে পানি প্রবেশ করলেও শুক্রবার দুপুরের জোয়ারের পানি উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ও আটুলিয়া ইউনিয়নের ৯টি গ্রামকে প্লাবিত করে। ফলে, হাজারো মানুষ পানিবন্দী হয়ে যায়। পাশাপাশি ১০ হাজার বিঘা জমির চিংড়ি ঘেরসহ শতাধিক মিষ্টি পানির পুকুর ভেসে গেছে।

স্থানীয়রা ভাঙনের জন্য বাঁধের কাজের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারকে দায়ী করছেন। তাঁদের দাবি সংস্কার কাজে গুণগত মান রক্ষা না করায় এবং পাশের খোলপেটুয়া নদী থেকে অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ওই অংশের বাঁধ নদীতে ধসে গেছে।
এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা জানিয়েছে, সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখানে রিং বাঁধ নির্মাণ করে ভাঙনের বিস্তৃতি রোধের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

 

স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, শ্যামনগর উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহি অফিসার, পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে বাঁধের ওই অংশের প্রায় ১৫০ ফুট খোলপেটুয়া নদীতে বিলীন হয়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে সন্ধ্যার পর আশপাশের গ্রামগুলোর কিছু মানুষ ভাঙনকবলিত অংশে নিজস্ব প্রচেষ্টায় রিং বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা করেন। তবে রাত নেমে আসায় এবং নদীতে জোয়ারের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় কাজে বাধা পড়ে এক পর্যায়ে লোকালয়ে খোলপেটুয়ার লোনা পানি তীব্র বেগে ঢুকে পড়ে।

ভাঙনকবলিত অংশে রিং বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় শনিবার দুপুর পর্যন্ত বুড়িগোয়ালিনী ও পার্শ্ববর্তী আটুলিয়া ইউনিয়নের ১৪ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

 

ভাঙনের বিষয়ে শ্যামনগর পওর বিভাগ-২ এর সেকশন অফিসার মাসুদ রানা জানান, নদীর পাশের চর দেবে যাওয়ায় বাঁধ নদীতে বিলীন হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভাঙনের খবর পেয়েই তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন।

দুর্গাবাটি গ্রামের যে স্থানটিতে বাঁধ ধসে পানি ঢুকেছে, তার খুব কাছেই মলিনা রপ্তানের ঘর। স্বামী দিন এনে দিন খাওয়া লোক কোনোমতে চলছে পাঁচজনের সংসার। নদী ভাঙ্গন পরিবারে সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বাঁধের ধারে আরও অনেক বাড়িঘর।এসব বাড়িঘরে চুলা জ্বলছে না। সবগুলো পানির তলায়। কাছেই পানির ভেতরে কাজ করছিলেন জোসনা সরকার তিনি বললেন, লবণ পানির মধ্যে পড়ে আছি। কোথায় যাব? যাওয়ার তো কোনো জায়গা নেই। থাকার ঘর ডুবে আছে, চলার পথ ডুবে আছে, টয়লেট ডুবে আছে। পানি আনতে হয় দূরের কল থেকে। মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্যেরও অভাব দেখা দিয়েছে।একপাশে খোলপেটুয়া নদী। অন্য পাশে ডুবে থাকা বাড়িঘর, ফসলি মাঠ, চিংড়ির ঘের। অথচ নদী ভাঙ্গনের আগে এসব এলাকার ছবি ছিল অন্যরকম। মানুষের জীবন ছিল স্বাভাবিক। নদীর ধারের ইট বিছানো সোলিং রাস্তা মিশেছে মুন্সিগঞ্জ নীল ডুমুর কার্পেটিং বিছানো পথে। সড়কের দু’ধারে পানির নিচে ডুবন্ত বাড়িঘর। ডুবে থাকা চলার পথের ওপরে লাঠি দিয়ে চিহ্ন করে রাস্তাগুলো চিনে নিতে হচ্ছে ঘরের ভেতরে মাচা পেতে অধিকাংশ মানুষ বসবাস করছে কোনোমতে। যাদের ঘরে থাকার সুযোগ নেই, তারা অনেক আগেই কেউ চলে গেছে আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউবা বাঁধের ঢালে।

আরও খবর: সারাদেশ