জাতীয়

অনিয়মের দায়ে সিলগালা, তদবিরে খোলে তালা!

  প্রতিনিধি ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৪:১৭:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডে

 

অপচিকিৎসায় একের পর এক মৃত্যু নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ায় টনক নড়ল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মানহীন ও অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধে সারাদেশে আবারও চালানো হচ্ছে অভিযান। সেবার নামে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান করা হচ্ছে সিলগালা। আদায় করা হচ্ছে জরিমানাও।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধভাবে অনেক হাসপাতাল চলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাফিলতিতে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই ঘুম ভাঙে প্রশাসনের। এর আগেও বিভিন্ন সময় চালানো হয়েছে অভিযান; কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। অবৈধ প্রতিষ্ঠান শুধু বন্ধ করলেই হবে না, বছরজুড়ে থাকতে হবে তদারকি।

হাইকোর্টের নির্দেশ পেয়ে অবৈধভাবে চলা ১ হাজার ২৭টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে তালিকা স্থানীয় প্রশাসনে পাঠানো হয়। রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রমাণ মেলায় এ উদ্যোগ নেওয়া হলো। সারাদেশে অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে গত মঙ্গলবার অভিযান শুরু হয়েছে। এটি চলবে আরও ১৫ দিন। দু’দিনের অভিযানে সারাদেশে ৩০টির বেশি হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে বন্ধ করা হাসপাতাল চালু করতে মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক মহল থেকে চাপ আসছে। এর আগেও এমন অভিযানের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালককে বদলি করা হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়েছে। নিবন্ধনধারী হাসপাতাল অধিদপ্তরের দেওয়া ১০ নির্দেশনা ভঙ্গ করলেও শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই।

দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একটি অংশের নিবন্ধন নেই। এসব হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় সেবা নিয়ে চরম অসন্তুষ্টি রয়েছে। প্রতিনিয়ত ওঠে চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হলেও কিছুদিন পরই মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক নেতাদের তদবিরে চালু হয়ে যায়। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের অবকাঠামো মানসম্মত নয়। এদিকে বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮০ ভাগেরই যথাযথ অবকাঠামো নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা।

গত ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় শিশু আয়ান আহমেদ। এ ঘটনার পর হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ হাসপাতালের একটি তালিকা আদালতে জমা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে তালিকায় নাম রয়েছে ১ হাজার ২৭টি প্রতিষ্ঠানের। নিবন্ধনহীন এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধে ৬ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ‘চিকিৎসক ও রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্ব আমার। নিবন্ধন ছাড়া একটি হাসপাতালেরও সেবা পরিচালনা করার সুযোগ নেই।’ তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা নিয়ে এরই মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে লাইসেন্সধারী বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ১৫ হাজার ২৩৩। এ ছাড়া আবেদন করে নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে তিন হাজারের বেশি হাসপাতাল। অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে অভিযানের খবর শুনে নিবন্ধন ও লাইসেন্স নবায়নের আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে চারশর বেশি আবেদন জমা পড়েছে।

গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো অভিযান পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এদিন লাইসেন্স ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা করায় বেশ কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার  ও অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ ও জরিমানা করা হয়।

সব মিলিয়ে রাজধানীতে দু’দিনে ৯টি হাসপাতাল বন্ধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি হাসপাতালকে সতর্ক করা হয়েছে। গতকাল বিভিন্ন এলাকায় ১০টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে তিনটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার ছয়টি হাসপাতাল বন্ধ করা হয়। ক্লিনিক হাসপাতালসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই করা হয়। আভিযানিক দল দেখতে পায়, এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক নবায়নের জন্য অনলাইনে আবেদন করে বসে আছে। তাদের লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন না থাকায় দ্রুত নবায়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

যেসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে অথচ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব শর্ত মানছে না, পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য তাদের তিন মাস সময় দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তিন মাস হয়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যারা নিয়ম মেনে লাইসেন্স রিনিউ বা নতুন লাইসেন্স নেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন অভিযান চালানো হবে। এদিকে বুধবার দুপুরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠেকাতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, হৃদরোগ হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতাল থেকে দালাল চক্রের ৩৮ জনকে আটক করে র‍্যাব। এদের মধ্যে ১২ জনকে কারাদণ্ড ও ২৬ জনকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‍্যাব-২-এর উপঅধিনায়ক মেজর নাজমুল্লাহেল ওয়াদুদ।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কারণে সব চিকিৎসকের বদনাম করা ঠিক হবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে ও ভুল চিকিৎসা বন্ধে অভিযান চলমান থাকবে। বেসরকারি হাসপাতালকে নিয়মের মধ্যে আনতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হবে।

 

আরও খবর: জাতীয়