সারাদেশ

স্বাস্থ্যকর্তায় জিম্মি স্বাস্থ্যসেবা, লুটেপুটে খাচ্ছেন উপজেলার স্বাস্থ্য খাতের টাকা!

  প্রতিনিধি ২৪ অক্টোবর ২০২৩ , ২:৫১:৫২ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডে

তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। সরকারি কর্মচারী হিসেবে রোগীদের দেখভাল এবং সঠিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেওয়া তার দায়িত্ব। কিন্তু হাঁটছেন উল্টোপথে। স্ত্রীর মালিকানায় প্রতিষ্ঠা করেছেন বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানেই দেখছেন রোগী। সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীদের প্রলোভনে ফেলে পাঠান নিজেদের হাসপাতালে। যোগ্য চিকিৎসক এবং নার্স না থাকলেও সেখানে চলে জটিল রোগের অস্ত্রোপচার। ফলে মাঝেমধ্যেই ঘটছে রোগী মৃত্যুর ঘটনা। এমনকি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা অন্য হাসপাতালগুলোতেও ছড়ি ঘোরান তিনি। কমিশন বাণিজ্য এবং মতের অমিল হলেই বন্ধ করে দেন সেসব হাসপাতাল। নারী সহকর্মীকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা, দুর্নীতি, প্রতিবাদ করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অপরাধ করেও পদে বহাল থেকে লুটেপুটে খাচ্ছেন উপজেলার স্বাস্থ্য খাতের টাকা।

রাজধানীর অদূরে দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্র ভৈরব। দেশের আর দশটা উপজেলা শহরের চেয়ে আয়তনে বড় এই শহরটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শহরটিতে গড়ে উঠেছে ২৩টি হাসপাতাল। আর এসব হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার হাতে। এমনকি নিজের স্ত্রীর মালিকানায়ও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতাল নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।

 ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের খবরে উঠে এসেছে এমনই চিত্র। ওই খবরে বলা হয়েছে, সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন হাসপাতালের মালিকরা অভিযোগ করেছেন, ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহম্মেদ স্বাস্থ্যসেবাকে ঘিরে একটি বাণিজ্যিক মাফিয়া সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছেন মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল। বুলবুল আহমেদের এই সিন্ডিকেটের সহযোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ফরহাদ হোসেন। তিনিও স্ত্রীর নামে নিবন্ধন নিয়ে গড়ে তুলেছেন আরেকটি হাসপাতাল, যার নাম উইমেন্স হেলথ কেয়ার।

ওই সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়, ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে রোগী নেই। ভুক্তভোগীরা বলছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তাররা অফিসে থাকেন না। তারা বেসরকারি হাসপাতালেই সময় দেন। এ ছাড়া নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করতে হয় তাদের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা এক গৃহিণীর স্বামী আবু ইসাহাক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গরিব মানুষ আমরা। চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে এলে টেস্ট করতে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। পরে আবার ডাক্তার দেখাতে এলে তারা বলেন, স্যার এখানে নেই। মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে যান।’

প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবেদকের কাছে  আসা একটি ফোন কল রেকর্ডে শোনা যায়, ভৈরবের রামনগরের এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে চাইলে অন্য প্রান্তের চিকিৎসক তাকে ডা. বুলবুলের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলেন।

ভৈরবের লক্ষ্মীপুর রোডে অবস্থিত মা ও শিশু হাসপাতাল। আর ভৈরব-কিশোরগঞ্জ রোডের হাজী আসমত কলেজ এলাকার উল্লাপাড়ায় অবস্থিত উইমেন্স হেলথ কেয়ার। উপজেলা হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল দুটিতে পরপর পাঁচ দিন গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অসংখ্য রোগীর ভিড়। এমনকি তাদের সবাইকে বসতে দেওয়ার মতো জায়গাও নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতাল কেন্দ্রিক বাণিজ্য সিন্ডিকেটের প্রধান ডা. বুলবুল আহম্মেদ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিনি বসেন কালেভদ্রে। রোগী দেখেন নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীদের নিজের হাসপাতালে বাগিয়ে নেন। এমনকি নারী সহকর্মীও তার কাছে নিরাপদ নয়। শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে এক নারী সহকারী সার্জনকে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পদাবনতিও ঘটেছিল তার। তখন তাকে ভৈরব থেকে কুমিল্লায় আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে বদলি করা হয়। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে মাত্র ১৪ দিন পরই ভৈরবে স্বপদে ফিরে আসেন। সেই থেকে আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠেন এই চিকিৎসক। তার সঙ্গে মতের অমিল হলে ক্ষমতাবলে বন্ধ করে দেন অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক। ভৈরব উপজেলার ২৩টি বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তার কাছে জিম্মি। অনেকে গোপনে তাকে ম্যানেজ করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখেন। যারা তাকে ম্যানেজ করতে পারেন না তাদের ওপর নেমে আসে খড়্গ।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, ডা. বুলবুল আহম্মেদের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ জন রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন।

এনবিষয়ে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহম্মেদের মোবাইল নম্বরে কল দেয় ওই প্রতিবেদক, তিনি ফোন ধরার পর সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগত হাসপাতাল পরিচালনাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জানানো হলে তিনি ‘ব্যস্ত আছেন’ জানিয়ে পরে ফোন করতে বলেন। এরপর বারবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।

মেডিকেল অফিসার ডা. ফরহাদ হোসেনের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

এই বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন ডা. সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একজন সরকারি চিকিৎসক চাকরিবিধি অনুযায়ী হাসপাতালে উপস্থিত না থাকলে কিংবা অন্য কোনো অনিয়মে জড়িয়ে পড়লে কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বেসরকারি হাসপাতালে অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু ভৈরব নয়, কিশোরগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা কর হয়। এখানে ব্যক্তিগত আক্রোশের কোনো সুযোগ নেই।’

ডা. বুলবুল আহম্মেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে তিনি তো বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কেউ অভিযোগ জানালে তদন্ত করে ব্যবস্থা করা হবে। সেখান থেকে অধিদপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন এলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’

আরও খবর: সারাদেশ