জাতীয়

স্বজনদের অসহায় আকুতি ‘সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলুন’

  প্রতিনিধি ২৯ নভেম্বর ২০২৩ , ২:০২:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ

 

বেলা ১১টা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জড়ো হয়েছেন কয়েকশ নারী ও শিশু। প্রায় সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। কারও চোখে পানি। কেউ কেউ কাঁদছেন শব্দ করে। গলায় ঝুলছে প্রিয়জনের ছবি, হাতে প্ল্যাকার্ড। কখনো মাইকেও ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। মুহূর্তেই ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। আশপাশে থাকা মানুষের চোখও অশ্রুতে ছলছল। জড়ো হওয়া অসহায় মানুষগুলো আর্তনাদ করে তাদের স্বজন ও পরিবারের ওপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন।

তাদের অভিযোগ-সরকারবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মী ও তাদের স্বজনদের ওপর কত ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, তা বর্ণনা করে শেষ করার মতো নয়। তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তুলে নিয়ে যাচ্ছে স্বজনদেরও। তাদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চলছে। পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হুমকিতে রাখা হয়েছে। সরকারের দমন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি চান তারা।

মঙ্গলবার ‘রাজবন্দিদের স্বজন’ সংগঠনের ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন কারাবন্দি ও সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের পরিবারের সদস্যরা। পরে গায়েবি মামলায় কারাবন্দি বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি নিয়ে যাত্রা করেন তারা। পুলিশ তাদের প্রেস ক্লাবের সামনেই আটকে দেয়। বিকালে কারাবন্দিদের স্বজনদের পক্ষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের সই করা স্মারকলিপি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে কারাবন্দি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন। এর আগে মানববন্ধনে অংশ নিয়ে কারাবন্দি এক বিএনপি নেতার অবুঝ শিশুসন্তান সিয়াম কান্নায় ভেঙে পড়ে। বলে, ‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন। ছেড়ে দেন।’

ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা আবদুল হাই ভুঁইয়া বলেন, ‘আমার তিন ছেলে ও এক ছেলের বউকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করে। যাদের গ্রেফতার করা হয়, তাদের দেখতে গেলেও আত্মীয়স্বজনকে আটকে থানায় হয়রানি করে পুলিশ।’

স্বামী ও অন্য নেতাদের মুক্তি চান ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা মনিরুজ্জামান মনিরের স্ত্রী শায়লা জেসমিন। কান্নজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার বয়স এখন ৭০ বছর। রাত দুটার সময় দরজা ভেঙে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। আমার স্বামী বয়স্ক, পুলিশকে কত আকুতি-মিনতি করলাম যে বয়স্ক, অসুস্থ, নির্দোষ লোকটাকে নেবেন না। কিন্তু পুলিশ বাসায় ভাঙচুর করে নির্দয়ভাবে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এখন কারাগারে আছে। তার সঙ্গে যোগাযোগও করতে দিচ্ছে না।’

জেলখানায় নিহত বিএনপি নেতা আবুল বাসারের স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামীকে গ্রেফতারের পর পুলিশ অমানবিক নির্যাতন করেছে। কারাগারে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে। সরকার আমার দুই সন্তানকে পিতৃহারা করেছে। এতিম সন্তানদের নিয়ে আমি মানবেতর জীবনযাবন করছি। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’

যুবদল নেতা লিয়ন হক ও রাজিব হাসানের বড় বোন আফরোজা পারভীন জেবা বলেন, ‘আমার ছোট ভাই রাজিব হাসানকে ৪ নভেম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। থানায় যোগাযোগ করলে কেউ স্বীকার করেনি। ৬ দিন পর একটা মামলা দিয়ে কারাগারে নেয়। পরে যখন আমি তার সঙ্গে দেখা করি, দেখতে পাই, রাজিব ক্ষতবিক্ষত। তার একটা নখ তুলে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। আমার আরেক ভাইকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। আমার বৃদ্ধ মাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালে আমার ভভগিনীতিকেও ঢাকার উত্তরা থেকে তুলে নিয়ে যায় র‌্যাব। পরে লক্ষ্মীপুরে তার লাশ পাওয়া যায়। তারা প্রথমে লাশও দিতে চায়নি। পরবর্তী সময়ে আমার বোনের নামেও কয়েকটি মামলা দিয়ে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলব, যদি আমার এবং আমার পরিবারের বাঁচার অধিকার না থাকে, তাহলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে মেরে ফেলুন, একজন একজন করে কষ্ট দিয়ে মারবেন না। আমরা বিএনপির রাজনীতি করে অপরাধ করেছি, আমরা পুরো পরিবার এখন মরতে চাই।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহানের স্ত্রী রহিমা শাহজাহান মায়া বলেন, ‘আমার স্বামীকে দুই বছরের জন্য জেল দিয়েছে, তার কোনো দোষ নেই। আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’

ছাত্রদল নেতা আমান উল্লাহ আমানের বড় ভাইয়ের মেয়ে মার্জিয়া বলেন, ‘আমার চাচাকে না পেয়ে পুলিশ আমার বাবাকে নিয়ে নির্যাতন করেছে। ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। পরে আমার চাচাকে গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে, তাকেও ৩ দফায় ১৩ দিন রিমান্ডে নিয়েছে। তাদের কী অপরাধ। তাদের অপরাধ-তারা তাদের ভোটের অধিকার চেয়েছিল।’

যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেনের স্ত্রী রাজিয়া বলেন, ‘আমার স্বামী কারাগারে আছেন। তার একটা মামলায় ৭ বছর, আরেক মামলায় তাকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যেখানে মামলার বাদী পুলিশ, মামলা করলও পুলিশ, সাক্ষ্যও দিল পুলিশ। আদালতে আমাদের আইনজীবীদের কথা বলতে দেওয়া হয়নি।’

বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ছেলে সৈয়দ আরাফাত আব্দুল্লাহ অন্তর বলেন, ‘আমার বাবার কিছুদিন আগে কিডনির অপারেশন হয়েছে। তিনি খুবই অসুস্থ। তার এ মুহূর্তে ভালো চিকিৎসা দরকার। কিন্তু কারাগার কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থাই করছে না’

২০১৩ সালে গুম হওয়া বিএনপি নেতা কাউসার হোসেনের স্ত্রী মিনা আক্তার বলেন, ‘আমার সন্তানের বয়স ১৩ বছর, সে বুঝ হওয়ার পর বাবাকে দেখেনি। যখন সে বলে, মা আমার বাবার মুখ কি আর দেখতে পারব না, তখন আমার বুক ফেটে যায়।’

 

আরও খবর: জাতীয়