সারাদেশ

মুক্ত বাতাসে আসার পরে সাংবাদিকদের যা বললেন আলোচিত সেই জল্লাদ

  নীলাকাশ টুডেঃ ১৯ জুন ২০২৩ , ৩:২৪:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

 

 

পাঁচ, দশ, কুড়ি নয়– টানা ৩২ বছর! মনোযন্ত্রণা আর হাহাকারে কাটল লাল দালানে। প্রাচীর পেরিয়ে অবশেষে পা ফেললেন নতুন জীবনে, দেখলেন মুক্ত আকাশ। যখন আঁধার ঠেলে আলোতে এলেন, তখন জীবন গাড়িটার বয়স ৭৩। তিনি শাহজাহান ভূঁইয়া। দেশের আলোচিত জল্লাদ।

গতকাল রোববারের সকালটা তাঁর মনে আঁকা থাকবে আমৃত্যু। মনের গহিন স্মৃতির ঝাঁপি নিয়ে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন ‘সাদা’ শার্ট-প্যান্টে; কোমরে ‘কালো’ বেল্ট। পোশাকেই জানান দিয়েছেন, জেলজীবন ছিল কতটা সাদা-কালো।

শাহজাহান তাঁর সাজা থেকে ক্ষমা পেয়েছেন ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন। কারাগার থেকে বেরিয়েই আবেগি কণ্ঠে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘দুনিয়ায় আমার কোনো আপনজন নেই। দেখেন না, কেউ তো আমাকে নিতে এলো না! কারাগারে কয়েকজন কারাবন্দির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাঁদের এক জনের বাসা বারিধারার নর্দায়। তাঁর বাড়ির দিকে রওনা হলাম।’

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার আবেদন। আমার ঘরবাড়ি নেই। এত বছর জেল খাটার পর আমার কিছুই নেই। জেল থেকে বেরিয়ে আমি নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না, আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছি। এখন আমি কী খাব? কোথায় যাব? কী করব? এখন আর কিছু করার বয়স নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাওয়া, আমাকে যেন একটি ঘর ও একটি কর্মসংস্থান দেন।’

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শোনান জেলজীবনের নানা অভিজ্ঞতা। কারাগারে ২৬ আসামির ফাঁসির দড়ি টেনেছেন। এর মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি। যুদ্ধাপরাধী চারজন, জেএমবি সদস্য দু’জন ও অন্য আলোচিত মামলার আরও ১৪ জন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শেষ কথা বলেছেন অনেক আসামি। কোনো আসামি বলেছেন, কোনো অন্যায় করিনি, কেউ লাশের ছবি তুলতে বারণ করেন। আবার কোনো আসামি মৃত্যুর আগে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ফুঁকেছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলাম। এ সময় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পেয়েছি। আমাকে আদর ও সম্মান করেছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে পেরেছন– এতে আপনার অনুভূতি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই অনুভূতিটা আমার কাছে ভালোই লাগছে।’

শাহজাহান বলেন, ‘প্রতিটি ফাঁসিতেই কিছু না কিছু আবেগ থাকে। আমার হাতে একটা লোকের জীবন যাচ্ছে। মানুষ যা কিছু করুর না কেন। যখন মৃত্যুর মুখে থাকে, তখন একটু না একটু মায়া লাগে। সেই মায়াটা না হয় আমি করলাম। কিন্তু কোর্ট ও আইন তো করবে না। যদিও মায়া লাগে, তবু কাজটি করতে হয়েছে। যত বড় অপরাধীই হোক, কাউকে ফাঁসির মঞ্চে দেখলে বড় মায়া হয়।’

ফাঁসির সময় আসামিদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, ‘এরশাদ শিকদারকে যখন ফাঁসি দিলাম, তখন উনি দাঁড়িয়ে একটি কথা বলছিলেন। আমার জীবনে আমি কোনো অন্যায় করেনি, আমার জন্য দোয়া করবেন।’ ফাঁসির আগে বাংলাভাই তেমন কিছু বলেননি। ফাঁসির আগে শুধু বলেছিলেন, মৃত্যুর পর কেউ যেন তাঁর ছবি না ওঠায়।

ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কী বলেছিলেন– প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কোনো কথা বলেনি। যুদ্ধাপরাধীরাও ফাঁসির আগে কোনো কথা বলেনি। তবে শহীদ বুদ্ধিজীবীকন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি মুনীর ফাঁসির আগে বলেছিলেন, আমাকে একটা সিগারেট দেন, আমি খাব।’

ফাঁসির আগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শাহজাহান বলেন, ‘একটা মানুষ যতই উচ্ছৃঙ্খল থাকুক না কেন, যখন সে জানছে আজ আমি দুনিয়া থেকে চলে যাব। তখন মুখ দিয়ে খারাপ কথা আসে না।

চুপচাপই থাকে। জেলে থাকা অবস্থায় কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছে বলে জেনেছি। তবে ফাঁসির দিন উনি কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেননি। উনি বুঝতে পেরেছেন, এখানে উচ্ছৃঙ্খলতা করে কোনো লাভ নেই।’ ফাঁসির সময় সাকা চৌধুরীর মাথা আলাদা হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘না, না এটা হয়নি। এটা কখনও হয় না। ফাঁসির সময় কারও মাথাই আলাদা হয় না, এগুলো সম্পূর্ণ ভুয়া কথা। আসামির উচ্চতা ও ওজন অনুযায়ী ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমি অপরাধ করেছি। সে জন্য জেলে এসেছি, সাজা ভোগ করেছি। আপনারা এখন আমার প্রতি মায়া দেখাচ্ছেন– লোকটা এত বছর জেল খেটেছে। আমার পেছনের দিকটা যদি আপনারা টান দেন, তাহলে আমি অতীতে কেমন ছিলাম। এখন আমি মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো অতীতের সবকিছু ভুলে গেছি। এখন আমি কীভাবে আগামী দিনে চলব, থাকব, সেটা হচ্ছে বিষয়।’

নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফাঁসি আমার হুকুমে হয়নি। রাষ্ট্রের হুকুমে আমি ফাঁসি দিয়েছি। আমি বিচার প্রক্রিয়া শেষে কারাগারে সাজা ভোগ করছি। তাই কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। আমি সাহসী ছিলাম বলে আমাকে জল্লাদের কাজে নিয়োগ করা হয়। এই কাজ আমি না করলে অন্য কেউ করত।’

শাহজাহান বের হওয়ার আগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মানিকগঞ্জের দুটি মামলায় তাঁর সাজা হয় ৪২ বছর। জেলে ভালো কাজ করায় রেয়াত (সাজা মওকুফ) হয়েছে ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন। আর তিনি ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন সাজা ভোগ করেন। জল্লাদ শাহজাহান এ পর্যন্ত ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন। এতে প্রতি ফাঁসির জন্য তাঁর দুই মাস করে শাস্তি মওকুফ হয়েছে। জেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে মুক্তির পর শাহজাহানকে খরচের জন্য কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে।

আরও খবর: সারাদেশ