বহুগুণ ব্যয়েও ভুল রিপোর্ট, ডায়াগনস্টিক পরিক্ষা ভিন্ন ল্যাবে ভিন্ন ফল


MD Nuruzzaman প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০২৩, ৬:৫৮ পূর্বাহ্ন /
বহুগুণ ব্যয়েও ভুল রিপোর্ট, ডায়াগনস্টিক পরিক্ষা ভিন্ন ল্যাবে ভিন্ন ফল

দেশে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষে বহুগুণ বেশি ব্যয়ে রোগ নির্ণয় করা হলেও প্রায়ই দেওয়া হচ্ছে ভুল রিপোর্ট। জেলা থেকে শুরু করে বিভাগীয় পর্যায়ে, এমনকি রাজধানীর সুপরিচিত পপুলার ও ইবনে সিনার মতো প্রতিষ্ঠানেও এমন কাণ্ড ঘটছে। এতে করে একই পরীক্ষা পুনর্বার করতে হচ্ছে। ফলে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, রোগী ও স্বজনদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

এসব কাণ্ডের জেরে রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত উপকরণের (রিএজেন্ট) মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এসব অনিয়ম দেখার কথা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু তাদের কোনো তদারকি নেই, নেই কার্যকর কোনো নীতিমালা, নেই কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরি। ফলে উদ্বেগজনক হলেও সত্যি, ভুল রিপোর্ট প্রদানের মতো মারাত্মক কাণ্ডেরও প্রতিকার মিলছে না।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো কী পরীক্ষা করছে, কী সেবা দিচ্ছে তা দেখার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বাস্তবায়নে অবশ্য সময় লাগবে, জানান তিনি। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা ফারহানা শেখের ছেলে আরিফ মাহমুদ। ১৪ বছর বয়সী আরিফের বুকে ব্যথা শুরু হলে গত বছরের ১৫ জুন নেওয়া হয় স্থানীয় পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বুকের সিটি স্ক্যানে মেসোথেলিয়মা নামক দুরারোগ্য ক্যানসারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়। বিষয়টি নিশ্চিত হতে বনানীর প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানে এফএনএসি পরীক্ষা করা হয়। সেখানেও একই ফল আসে। সঙ্গত কারণেই ঘাবড়ে যান ফারহানা শেখ। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এবং পান্থপথের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পুনরায় পরীক্ষা করান। দুই প্রতিষ্ঠানেরই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, ক্যানসারের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এতে করে ফারহানা শেখ কিছুটা আশ্বস্ত হলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ছেলেকে নিয়ে ভারতে যান। সেখানে বায়োপসির ফল আসে বিএসএমএমইউর মতোই নেগেটিভ।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ফারহানা শেখ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, প্রথম দুটি পরীক্ষায় যে ক্যানসারের কথা বলা হয়েছিল, আমার ছেলের সে ধরনের কোনো উপসর্গই ছিল না। দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানের রোগ নির্ণয়ের মান যদি এ রকম হয়, তা হলে বাকিগুলোর কি অবস্থা হতে পারে? উৎকণ্ঠার সঙ্গে তিনি বলেন, ভুল রিপোর্টের জেরে ভুল ওষুধ খেয়ে রোগীর মৃত্যু হওয়াও অস্বাভাবিক নয়!

রক্ত পরীক্ষার জন্য আরেক নামকরা প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনার মিরপুর শাখায় যান রায়হান শোভন। পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা দেখে চমকে যান তিনি। চিকিৎসক জানান, এটি জন্ডিসের লক্ষণ। কিন্তু চোখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থান দেখে ওই চিকিৎসকও পরীক্ষার ফল নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন।

পরে সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিক্যালে পরীক্ষা করালে ফল আসে স্বাভাবিক। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ইবনে সিনার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অসম্মতি প্রকাশ করেন। পরে প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এক কর্মকর্তা  বলেন, রিএজেন্টের সমস্যার কারণে পরীক্ষার ফল ভুল এসেছিল। আরও বেশকিছু পরীক্ষায়ও এমন কাণ্ড ঘটেছিল। পরে ধানমন্ডি শাখায় পরীক্ষা করা হলে সঠিক ফল আসে। আরও নিশ্চিত হতে রোগীকে বিএসএসএমইউতে পরীক্ষা করানো হয়েছিল, সেখানেও একই ফল আসে।

এ তো গেল খোদ রাজধানীর নামকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কথা। বলা বাহুল্য, ঢাকার বাইরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। কুষ্টিয়া সদরের আক্তার মণ্ডলের ছেলে আজমিরের (১৩) কথাই ধরা যাক। পেটে ব্যথার জন্য গত বছরের ২৩ অক্টোবর কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। দায়িত্বরত চিকিৎসক তার আলট্রাসনোগ্রাম করানোর পরামর্শ দেন। ওই দিনই ছেলেকে নিয়ে আক্তার মণ্ডল যান স্থানীয় আমিন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আজমিরের লিভারে ইনফেকশন হয়েছে বলে জানানো হয়। সে অনুযায়ী ওষুধও লিখে দেন চিকিৎসক। ওষুধ সেবনে ব্যথা কমলেও দ্রুত পেট ফুলে যেতে থাকে। অবস্থার অবনতি হলে ওই একই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আজমিরকে। কিন্তু পরীক্ষার ফল নিয়ে চিকিৎসকের সন্দেহ হওয়ায় আরও দুটি ডায়াগনিস্টক সেন্টারে পরীক্ষা করা হয়। শেষের দুটি সেন্টারে বার্স্ট অ্যাপেন্ডিক্স ধরা পড়ে। পরে দ্রুত আজমিরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তার অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে আক্তার মণ্ডলের। বাঁচানো যায়নি তার ছেলে আজমিরকে।

আজমিরের মা শাহানারা খাতুন বলেন, ডাক্তারের কোনো দোষ ছিল না, ভুল রিপোর্টের কারণে আমার ছেলে মারা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে সেবার মান ভালো হলেও চাহিদা অনুযায়ী সেবা না পাওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেতে বাধ্য হন রোগীরা। কিন্তু সেখানেও এখন প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় যাচ্ছেতাই সেবা দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।

বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মান নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জও বেড়ে যায়। এ জন্য নীতিমালা থাকা দরকার। কিন্তু সেটি নেই। এর পরও যে সক্ষমতা রয়েছে, সেটি অন্তত কাজে লাগাতে হবে।

সক্ষমতায় ঘাটতির কথা স্বীকার করে ডিজিডিএর পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, মাঠপর্যায়ে ল্যাবগুলোতে রিএজেন্টের গুণগত মান কতটুকু আছে, তা তদারকের মতো কার্যক্রম আমাদের নেই। যন্ত্রগুলো দেশে এলে এফডিএসহ অন্যান্য কাগজপত্র, গুণগত মান ও কোন কোন দেশে সেগুলো ব্যবহার হয়ে থাকে, আমরা সেটি দেখে থাকি। কিন্তু ল্যাবে গিয়ে গুণগত মান ঠিক থাকছে কিনা, পরীক্ষার ফল ঠিকমতো দিচ্ছে কিনা এবং মেয়াদোত্তীর্ণের পরও পরীক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেসব দেখা হয় না। আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে।