জাতীয়

তাপপ্রবাহে হিটস্ট্রোকে শিশুসহ ১২ মৃত্যু

  নীলাকাশ টুডে ২৯ এপ্রিল ২০২৪ , ৫:৪১:০৬ প্রিন্ট সংস্করণ

 

আগুনঝরা গরমে নাভিশ্বাস অবস্থা মানুষের। প্রতিদিন হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। প্রখর তাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে হিটস্ট্রোকে শিশু শিক্ষার্থীসহ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে তীব্র হতে অতি তীব্র তাপদাহে জনজীবন কাহিল। সিলেট বাদে পুড়ছে পুরো দেশ, বিপর্যস্ত জনজীবন। পাশাপাশি হিটস্ট্রোকে পশুপাখিও মারা যাচ্ছে। বেড়েছে ডায়রিয়া, জ্বরসহ বিভিন্ন রোগ। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। চলমান তাপপ্রবাহ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আরও ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

গতকাল রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায়, ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে, এক দিনের ব্যবধানে ঢাকার তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। গতকাল রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা শনিবারের চেয়ে ১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি।

এ ছাড়া রাজশাহীতে ৪২, চুয়াডাঙ্গায় ৪১ দশমিক ৮, সাতক্ষীরায় ৪১ দশমিক ১, বাগেরহাটের মোংলায় ৪১, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ৪০ দশমিক ৮, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৪০ দশমিক ৫, ফরিদপুরে ৪০ দশমিক ৬, টাঙ্গাইলে ৪০ দশমিক ৩, খুলনা ও নওগাঁর বদলগাছীতে ৪০, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও দিনাজপুরে ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

বাতাসে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ ধরা হয়। ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে হলে তাকে মাঝারি এবং ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলিসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। আর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির ওপরে উঠলে তাকে বলা হয় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।

আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেন, এখন যে পরিস্থিতি, তাতে এ মাসে তাপমাত্রা খুব বেশি তারতম্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। অন্তত আজ সোমবারও তাপমাত্রা এ রকমই থাকতে পারে।

দেশের ৫২ জেলায় তাপপ্রবাহের কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সংস্থাটি জানিয়েছে, যশোর ও রাজশাহীর ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা, নীলফামারী জেলাসহ খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও বান্দরবান জেলাসহ ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বিরাজমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে।

পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। গতকাল সিলেটে ১৮ ও শ্রীমঙ্গলে ১৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সতর্কবার্তায় বলা হয়, দেশের ওপর দিয়ে চলমান তাপপ্রবাহ রোববার থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বাড়তে পারে।

বৃষ্টি না হওয়ায় এবার চৈত্র মাসের শেষ সময় থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। চলতি মৌসুমে ৩১ মার্চ থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে মাত্রা বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত টানা ২৯ দিন ধরে তাপপ্রবাহ চলছে, যা নজিরবিহীন।

আবহাওয়াবিদরা এ বছর তাপপ্রবাহ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার পেছনে এপ্রিলে দেশে কালবৈশাখী না হওয়াকে অন্যতম অনুষঙ্গ বলে তুলে ধরেছেন। তারা জানান, দিন দিন এপ্রিল মাসে তাপপ্রবাহ বাড়ছে আর কমছে বজ্রঝড়ের সংখ্যা। চলতি এপ্রিল মাসে গত ৭৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রতি বছর এপ্রিল মাসে ৭-৮টি কালবৈশাখী-বজ্রঝড় হয়। কিন্তু এবার হয়েছে মাত্র একটি। বৈশাখ মাসের সঙ্গে বৈশাখী ঝড়ের এক নিবিড় সম্পর্ক। মধ্য এপ্রিলে শুরু হওয়া বৈশাখের আজ (রোববার) ১৫ তারিখ। কিন্তু এবার এ ঝড়ের সংখ্যা সামান্য, যা হয়েছে সিলেট বিভাগেই। ফলে সিলেটের তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে। এপ্রিল মাসে সাধারণত তাপপ্রবাহ হয়। আবার এক সময় বজ্রঝড় হয়ে সেই গরম প্রশমিত হয়। অতঃপর আবহাওয়া একসময় আবার গরম হয়। এভাবে তাপ ও ঝড়বৃষ্টির মধ্য দিয়ে চলে এ মাস। কিন্তু এবারের এপ্রিল মাসে ঘটেছে ব্যতিক্রম। তীব্র তাপপ্রবাহ, জলবায়ু পরিবর্তন, বজ্রমেঘ সৃষ্টি না হওয়া—এসব কারণেই বজ্রঝড়ের সংখ্যা কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বজ্রঝড় কমে যাওয়ার এ অবস্থা অস্বাভাবিক। গত ৭ এপ্রিল দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী বয়ে যায়। দক্ষিণ জনপদে এ সময় ঝড় বেশ অস্বাভাবিক।

হিটস্ট্রোকে আরও ১২ জনের মৃত্যু: প্রচণ্ড গরমের মধ্যে রোববার দুপুরে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন কারওয়ান বাজারের মাংস বিক্রেতা মো. সেলিম (৫৫)। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। অটোরিকশাচালক মো. রুবেল জানান, সেলিম অটোরিকশা ভাড়া করে যাত্রাবাড়ীতে ছাগল কিনতে যান। সেখান থেকে কারওয়ান বাজারে ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

রাজশাহীর পবা উপজেলার কাদিপুর গ্রামে দিলীপ বিশ্বাস (৩৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে নিজ বাড়িতে হঠাৎ স্ট্রোক করে তিনি মারা যান। তার বাবার নাম গোপাল বিশ্বাস। স্থানীয়দের ধারণা, হিটস্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে।

চট্টগ্রামে হিটস্ট্রোকে দুজন মারা গেছেন। এর মধ্যে কালুরঘাট ফেরিতে মাওলানা মোস্তাক আহমেদ কুতুবী আলকাদেরী (৫৫) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক মারা যান। তিনি বোয়ালখালী উপজেলার খিতাপচর আজিজিয়া মাবুদিয়া আলিম মাদ্রাসায় কর্মরত ছিলেন। গতকাল তিনি নগরীর চান্দগাঁও মোহরা এলাকার বাসা থেকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৯টার দিকে কালুরঘাটের পশ্চিম পাড় থেকে হেঁটে ফেরিতে ওঠার পরই ঢলে পড়েন তিনি। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে মিরসরাইয়ে হিটস্ট্রোকে জাহাঙ্গীর আলম (৫৩) নামে এক আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু হয়েছে। তিনি মঘাদিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার স্বজন সাজ্জাদ হোসেন পিটু জানান, সকালে ক্ষেতে মরিচ তুলতে যান জাহাঙ্গীর। বাড়ি ফেরার সময় জমির আইলে মাথা ঘুরে পড়ে যান। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বেঙ্গাউতা গ্রামে ধান কাটতে গিয়ে হিটস্ট্রোকে জাকির মিয়া (৩০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তার চাচাতো বোন হাফিজা বেগম জানান, প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কাজ করার সময় বুকে ব্যথা অনুভব করেন জাকির। পরে তাকে বাড়িতে এনে মাথায় পানি ঢালা হয়। এরপর হাসপাতালে নেওয়ার সময় মারা যান।

মাদারীপুরে তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে কালকিনি উপজেলার পশ্চিম শিকার মঙ্গল গ্রামে প্লাস্টিক কারখানার ব্যবসায়ী শাহাদাৎ সরদার প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর বুকে ব্যথা হলে ছটফট করে মারা যান। এদিকে বাড়ির পাশে পাটক্ষেতে কাজে গিয়ে প্রচণ্ড রোদে অসুস্থ হয়ে মারা যান ডাসার উপজেলার পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামের কৃষক মোসলেম ঘরামী।

যশোরে ধান কেটে বাড়ি আসার পর হিটস্ট্রোকে আহসান হাবীব নামে এক স্কুল শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি সদর উপজেলার আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক এ জেড এম পারভেজ মাসুদ জানান, আহসান হাবীব সকাল ৯টার দিকে স্কুলে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক জানান তিনি মারা গেছেন।

নরসিংদীতে গতকাল বিকেল ৩টার দিকে হিটস্ট্রোকে আদালত প্রাঙ্গণে সুলতান উদ্দিন মিয়া (৭২) নামে এক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। তিনি নরসিংদী কোর্টে আইনজীবীর সহকারী (মুহুরি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বজনরা জানান, কোর্টে কাজ করার সময় তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। একপর্যায়ে তার মৃত্যু হয়।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নুর ইসলাম ওরফে ভোলা মিয়া (৪৭) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বিকেলে উপজেলার হরিরামপুর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাড়ির পাশে গরুর জন্য ঘাস কাটতে যান তিনি। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। দুপুরের পর অন্য কৃষকরা তাকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন।

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় হিটস্ট্রোকে কামরুল হাসান ফাহিম (৭) এক স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সে উপজেলার চরক্লাকর্ক ইউনিয়নের কেরামতপুর গ্রামের ওমর ফারুকের ছেলে। কেরামতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত ফাহিম।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. সেকান্তর আলম বলেন, ফাহিম সকালে স্কুলে আসে। কিন্তু স্কুলে উপজেলা নির্বাচন-সংক্রান্ত ট্রেনিং থাকায় ক্লাস হয়নি। পরে সে বাড়ি যায়। বাড়িতে অন্য শিশুদের সঙ্গে রোদের মধ্যে খেলাধুলা করার সময় সে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। পরে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। ধারণা করা হচ্ছে, হিটস্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে হিটস্ট্রোক স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে ধারণা করা হলেও পরে জানা যায়, তার মৃগী রোগ ছিল।

তবে ফাহিমের চাচা মো. জাকার মাস্টার দাবি করেন, তার ভাতিজার মৃগী রোগ ছিল না।

টাঙ্গাইলের গোপালপুরে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ফেরদৌস আলম ঠান্ডু (৫০) নামে এক চা বিক্রেতার মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টার দিকে বেলুয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল করিম জানান, ঠান্ডু বেলুয়া বাজার থেকে দুধ কিনে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।

 

আরও খবর: জাতীয়