জাতীয়

ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সিত্রাংয়ে ঝরল ৩১ প্রাণ

  প্রতিনিধি ২৬ অক্টোবর ২০২২ , ১:৪০:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডেঃ

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে ১৪ জেলায় শিশু ও নারীসহ ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামের মীরসরাই উপকূলে ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ভোলার চার উপজেলায় পাঁচজন, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে তিনজন, সিরাজগঞ্জে মা ও ছেলে, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে মা ও মেয়ে, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দুই নারী, টাঙ্গাইলে দুজন, পটুয়াখালীতে ট্রলার শ্রমিক, শরীয়তপুরের জাজিরায় গৃহবধূ, বরগুনায় শতবর্ষী নারী, নড়াইলের লোহাগড়ায় গৃহপরিচারিকা, গাজীপুরের কাপাসিয়ায় শিশু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে সারা দেশে হাজার হাজার ঘরবাড়ি এবং কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল এবং হাজার খানেক মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সোমবার সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দমকা হাওয়া ও অবিরাম ভারি বর্ষণে ভেঙে পড়া গাছের চাপায়, জোয়ারের পানিতে ডুবে এবং নৌদুর্ঘটনায় এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এছাড়া সিত্রাংয়ের প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোয় বসতঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাছের ঘের, আমন ও কলাখেত, পানের বরজসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গাছ উপড়ে যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। অবিরাম বর্ষণ ও অমাবস্যার জো-এ নিম্নাঞ্চল পানিতে প্লাবিত হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। গাছ পড়ে রেললাইন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বৈদ্যুতিক তারের ওপর গাছপালা ভেঙে পড়ায় বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ বিছিন্ন হয়ে পড়ে।

মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকায় এক ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে সারা দেশে ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ছয় হাজার হেক্টর জমির ফসল এবং এক হাজার মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর মেরামতে সরকারের তরফ থেকে টিন ও নির্মাণসামগ্রী দেওয়া হবে। আর যাদের মাছের ঘের নষ্ট হয়েছে, তারা সুদমুক্ত ঋণ পাবেন। তিনি জানান, দুর্যোগে মারা যাওয়া প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, এর মধ্যে গোপালগঞ্জে মৃত দুইজনের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঝড়ের প্রকৃত ক্ষতির চিত্র জানতে আরও ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য টিন ও নগদ অর্থ বুধবার থেকে দেওয়া শুরু হবে। তিনি বলেন, মহান আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। যেভাবে সিত্রাং সৃষ্টি হয়েছিল, যেসব পূর্বাভাস ছিল, যেভাবে সরাসরি বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছিল, তাতে পূর্বাভাস ছিল অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কিন্তু সিত্রাং ঘূর্ণিঝড় হিসাবেই ছিল, এটা প্রবল বা অতিপ্রবল বা সুপার সাইক্লোন কোনোটাতেই রূপ নেয়নি। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটারের ওপরে যায়নি। আমাদের যে ঘোষণা ছিল, সেই সময়ের অনেক আগেই অনেক দ্রুতগতিতে উপকূল অতিক্রম করেছে। পূর্বাভাস ছিল-এটা বরগুনা ও পটুয়াখালীর ওপর দিয়ে যাবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি আরও উত্তর-পূর্বদিকে টার্ন নেওয়ার কারণে পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে অতিবাহিত হয়।

প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, আমাদের প্রায় ৬ হাজার ৯২৫ আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় যেহেতু রাত ১০টার পরে অতিক্রম করেছে, আশ্রিত মানুষ মধ্যরাত থেকে আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করে বাড়িতে যাওয়া শুরু করে। সকাল হতে হতে সব কেন্দ্র খালি হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়টি আবার লঘুচাপে পরিণত হয়। তবে ঘূর্ণিঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে গেছে।

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমানে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো প্রভাব নেই। চট্টগ্রামসহ অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ যেগুলো বিচ্ছিন্ন ছিল, যেগুলো এখন মেরামত করে দ্রুত সংযোগের চেষ্টা চলছে। ঢাকায় অনেক গাছ পড়েছে। কয়েক জায়গায় রাস্তা বন্ধ ছিল। তবে দ্রুত এগুলো সরানো হয়েছে। মোহাম্মদপুরে বেশ জলাবদ্ধতা হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় কোনো ক্ষতি হয়নি। মাছের ঘেরের ক্ষতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে।

প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, বড় জলোচ্ছ্বাস হয়নি। শুধু ভোলায় ৭ ফুট জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় সেখানে ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্যত্র সর্বোচ্চ ২ ফুট পানি প্রবেশ করেছে। আমরা জেলা প্রশাসনকে বলেছি চাহিদা পাঠাতে। চাহিদা এলেই আমরা বরাদ্দ দিতে পারব। মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্ত খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি লাগে আরও বরাদ্দ দেওয়া হবে।

আরেকটি ঝড় আসছে : ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, আগামী ডিসেম্বরে দেশে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে। এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সোমবার রাত ১টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করে জানান, এটা (ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং) ভালোভাবে মোকাবিলা করেছ। এজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু ডিসেম্বরে আরেকটা ঘূর্ণিঝড় আসবে, সেটির ব্যাপারে একইরকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

মীরসরাই (চট্টগ্রাম) : সোমবার রাত ১০টার দিকে মীরসরাই উপকূলে ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার ১৬ নম্বর সাহেরখালী ইউনিয়নের বসুন্ধরা এলাকায় বেড়িবাঁধসংলগ্ন সাগরে বালু উত্তোলনের জন্য ড্রেজারটি রাখা ছিল। সিত্রাংয়ের আঘাতে সেটি ডুবে যায়। মঙ্গলবার বিকালে ড্রেজারের ভেতর থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। মৃতদের কয়েকজন হলো-ড্রেজার মেশিন ‘সৈকত-২’-এর শ্রমিক ইমাম মোল্লা (৪৮), মাহমুদ মোল্লা (৫০), আলামিন (৪২), তারেক ( ৪৫) ও আবুল বশর (৫৪)। তাদের সবার বাড়ি পটুয়াখালীর জৈনকাঠি ও মোল্লাবাড়ী থানায়। ড্রেজার শ্রমিক আব্দুস সালাম জানান, ড্রেজারে আমরা ৯ জন ছিলাম। ঝড়ের খবর শুনে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমি চলে আসি। তবে বাকিরা সেখানেই ছিল। ড্রেজারের ম্যানেজার রেজাউল করিম বলেন, ঘটনাস্থলে আরও ছয়টি ড্রেজার ছিল। সতর্ক সংকেত পেয়ে অন্যসব শ্রমিক নিরাপদ স্থানে চলে গেলেও আট শ্রমিক আসেননি। উপজেলার ১৬নং সাহেরখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হায়দার চৌধুরী বলেন, সোমবার বিকালে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে মাইকিং করে সবাইকে নিরাপদ অবস্থানে চলে যেতে বলা হয়। এরপরও শ্রমিকরা কেন নিরাপদ আশ্রয়ে গেল না বুঝতে পারছি না।

ভোলা : ভোলা সদর, দৌলতখান, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলায় চারজনের মৃত্যু এবং ১০ জন আহত হয়েছে। বসতঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ায় সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চেওয়াখালী গ্রামের মফিজুল ইসলাম ও দৌলতখান পৌর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের খাতিজা বেগম, চরফ্যাশন উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের মনির হোসেন মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় গাছচাপায় এবং লালমোহন উপজেলার লর্ডহাডিঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে গৃহবধূ রাবেয়া বেগম জোয়ারের পানিতে ডুবে মারা গেছেন। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে পাঁচ শতাধিক ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত এবং হাজারের অধিক ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।

কুমিল্লা : নাঙ্গলকোটে প্রবাসী পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো-খামারপাড়া গ্রামের প্রবাসী নিজাম উদ্দিন (২৮), তার স্ত্রী সাথী আক্তার (২৪) ও মেয়ে লিজা (৪)। হেসাখাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার মজুমদার জানান, সোমবার রাতে প্রবল বাতাসে প্রবাসীর ঘরের ওপর একটি গাছ ভেঙে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজনের মৃত্যু হয়। গাছ পড়ে রেললাইন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় পুরো জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। লালমাই উপজেলার বাগমারা দক্ষিণ ইউনিয়নের আশকামতা গ্রামে ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে এক পরিবারের চারজন আহত হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ও মঙ্গলবারের সব পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সিরাজগঞ্জ : যমুনায় নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো-পূর্ব মোহনপুর গ্রামের খোকন শেখের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা ও শিশু সন্তান আরাফাত। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোসাদ্দেক হোসেন জানান, সোমবার রাতে সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব মোহনপুরের ক্যানেল পার হওয়ার সময় নৌকাটি ডুবে যায়। এতে ঘটনাস্থলে শিশু আরাফাত মারা যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা অভিযান চালিয়ে আয়েশাকে উদ্ধার করে। সিরাজগঞ্জ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) : লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে বসতঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ায় মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো-আসমা বেগম আশু (২৮) ও তার মেয়ে সুরাইয়ার (৩)। এছাড়া বাবা ও ছেলে গুরুতর আহত হয়। সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহত আবদুর রাজ্জাককে (৩৫) ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল এবং ছেলে আরাফাতকে (১০) স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লৌহজং থানার ওসি আবদুল্লাহ আল তায়েবীর জানান, মঙ্গলবার ভোরে স্থানীয়রা ঘরটি থেকে দুই লাশ ও আহত দুজনকে উদ্ধার করে।

গোপালগঞ্জ : টুঙ্গিপাড়ায় গাছচাপায় দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো-পাঁচকাহনীয়া গ্রামের রেজাউল খাঁর স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়িয়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রুমিছা বেগম (৬৫)। টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি আবুল মনসুর জানান, ঘরের বারান্দায় বসে শারমিন কাজ করার সময় একটি খেজুর গাছ ঘরের ওপর ভেঙে পড়ে। গাছের চাপায় তার মৃত্যু হয়। এছাড়া ঘরে শুয়ে থাকা অবস্থায় গাছ ভেঙে পড়ায় রুমিছার মৃত্যু হয়।

পটুয়াখালী : পটুয়াখালীতে ট্রলার শ্রমিক নুরুল ইসলামের (৪৫) মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার ১৪ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল তার লাশ উদ্ধার করে। সোমবার রাত ৯টার দিকে লোহালিয়া নদীর প্রতাপপুর এলাকায় মালবাহী ট্রলারটি উলটে যায়। এরপর থেকে নূরুল নিখোঁজ ছিল। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারের মালিক জলিল মাঝি জানান, সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ট্রলারটি উলটে যায়। এ সময় অন্যরা তীরে উঠতে পারলেও নুরুল পানিতে তলিয়ে যায়। লোহালিয়া ইউনিয়নের নাজিপুরের বশির মোল্লার ছেলে নুরুল।

শরীয়তপুর : জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে গাছচাপায় হালান মুসল্লির স্ত্রী সাফিয়া বেগমের (৫৫) মৃত্যু হয়েছে। পদ্মা নদীর চর চিটারচরের ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়লে সাফিয়া মারা যায়। কুন্ডেরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন বেপারি বলেন, সাফিয়া বাড়িতে থেকে যান। রাতে ঘরের ওপর গাছ পড়লে তিনি মারা যান। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শীতকালীন বিভিন্ন শাকসবজির পাশাপাশি মৌসুমি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

বরগুনা : সদর উপজেলার সোনাখালী গ্রামে ঘরের ওপর গাছ পড়ে শতবর্ষী আমেনা খাতুনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত ৮টার দিকে চাম্বল গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়ে। এ সময় ঘরে থাকা ১১৫ বছর বয়সি আমেনা ঘটনাস্থলে মারা যান। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব কুমার জানান, সিত্রাংয়ে বরগুনা জেলায় ৪৬৮টি মাছের খামার ও পুকুরের ক্ষতি হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জানায়, গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মেরামত করতে আরও ২-৩ দিন সময় লাগবে। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই।

লোহাগড়া (নড়াইল) : লোহাগড়ায় গাছের ডালের আঘাতে গৃহপরিচারিকা মর্জিনা বেগমের (৩৮) মৃত্যু হয়েছে। বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জুনবাহার গ্রামের আকবর আলী শেখের মেয়ে মর্জিনা লোহাগড়ার রাজুপুর গ্রামে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। সোমবার দুপুরে কাজের উদ্দেশে বের হন। উপজেলা চত্বরের পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কাছে পৌঁছলে মেহগনি গাছের ডাল ভেঙে তার মাথার ওপর পড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন?

কাপাসিয়া (গাজীপুর) : কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা ইউনিয়নে মাটির দেওয়াল ধসে নয় বছরের শিশু আনিসুর রহমানের মৃত্যু হয়েছে। ইকুরিয়া গ্রামের বেলায়েত মোল্লার দ্বিতীয় ছেলে আনিসুর। আহত বড় ছেলে আলামিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। সোমবার মধ্যরাতের এ দুর্ঘটনায় আরও তিনজন আহত হয়। অন্যরা চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। কাপাসিয়া থানার ওসি এএফএম নাসিম জানান, এ বিষয়ে থানার অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) : মঙ্গলবার সকালে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নে এক অজ্ঞাত শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কদমরসুল আছওয়া শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে ভেসে আসা মেয়েশিশুর লাশ দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেয়। নৌপুলিশের সহযোগিতায় গাউসিয়া কমিটি লাশ উদ্ধার করে।

নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : নবীনগর উপজেলায় বৈদ্যুতিক খুঁটি নিয়ে পানিতে পড়ে পল্লী বিদ্যুতের লাইনম্যান রিপন মিয়ার (২৮) মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার বিটঘর ইউনিয়নের টিয়ারা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। টিয়ারা গ্রামে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন মেরামতের সময় খুঁটিসহ পানিতে পড়ে যান রিপন। সরাইল উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের কানিউচ্চ গ্রামের বাসিন্দা রিপন নবীনগরের শিবপুর জোনে লাইনম্যান হিসাবে কাজ করতেন। নবীনগর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির শিবপুর জোনাল অফিসের এজিএম কামরুজ্জামান আশিক বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে টিয়ারা গ্রামে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যায়। মেরামত করার সময় বাতাসে তোড়ে বিদ্যুতের খুঁটিসহ রিপন পুকুরে পড়ে যান। স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) : কেরানীগঞ্জে দুটি আবাসিক বহুতল ভবন হেলে পড়েছে। সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড় চলাকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা উত্তরপাড়া হাজিনগর এলাকার শহিদুল ইসলামের পাঁচতলা ও জালাল উদ্দিনের চারতলা ভবন একটি আরেকটির ওপর হেলে পড়ে। ভবন হেলে পড়ার খবরে এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে রাতেই ফায়ার সার্ভিস ও শুভাঢ্যা ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় ভবন দুটির বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।

কক্সবাজার : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা ৬ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জোয়ারের প্লাবিত হয়। এতে করে সদর উপজেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালীর ধলঘাটা, সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ সময় ৫ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ও ১ হাজার ৪০০ ঘর সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। এ ছাড়া আকর্ষণীয় মেরিন ড্রাইভসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকটি সড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের কারণে সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টের ডায়াবেটিস পয়েন্ট ও হিমছড়ি, ইনানি এবং টেকনাফ পয়েন্টে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে।

মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন জানায়, কক্সবাজারের ৪৭টি ইউনিয়নের ২০০ গ্রাম জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব দুর্গত এলাকার অনেকে এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান জানান, ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায়নি।

বরিশাল : সিত্রাংয়ের প্রভাবে বরিশালে ৩১৪১টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে হিজলা উপজেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবার বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার জানান, আগৈলঝাড়ায় ৩৫, গৌরনদীতে ১১৫, উজিরপুরে ১৫০, বানারীপাড়ায় ১০০, বাবুগঞ্জে ১০৫, মুলাদীতে ৬০, হিজলায় ২২০০, মেহেন্দিগঞ্জে ১৩২, বরিশাল সদর ও মহানগরে ৬০ এবং বাকেরগঞ্জে ১৮১টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৫০৮টি ঘরবাড়ি আংশিক ও ৬৩৩টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। দুর্গতদের শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সহায়তাও করা হবে।

বরিশালে বিভাগে মৎস্যখাতে ২৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্লাবনের পানিতে পুকুর, ঘের (খামার), দিঘি তলিয়ে চাষের মাছ বের হয়ে গেছে। বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী ৬ জেলায় ১ হাজার ৫৭৩ হেক্টরের ১২ হাজার ১২টি পুকুর, দিঘি, খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১১ হাজার ১৮৯ জন মৎসচাষি ও খামার মালিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। বরিশালে পল্লী বিদ্যুতের ১৭০০ মিটার নষ্ট হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (বরিশাল-১, বরিশাল-২, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও ভোলা) প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী ৩৩২টি বৈদ্যুতিক পোল ভেঙে গেছে, ১১৯টি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে, ৩ হাজার ৮৩ স্পটে তার ছিঁড়ে গেছে, ১ হাজার ৭১৪টি মিটার তার নষ্ট হয়েছে।

এছাড়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে কিশোরগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, বাগেরহাট, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও বাঁশখালী, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও বন্দর, কুড়িগ্রামের চিলমারী, চাঁদপুরের কচুয়া ও ফরিদগঞ্জ, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগ, কুমিল্লার নাঙ্গলকোট, লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও রায়পুর, ফেনীর সোনাগাজী, মাদারীপুরের টেকেরহাট, বরগুনার বেতাগী, আমতলী ও তালতলী, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী ও বাউফল, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, ইন্দুরকানী ও ভাণ্ডারিয়া, বাগেরহাটের মোংলা, ভোলার লালমোহন, মনপুরা, দৌলতখান ও চরফ্যাশনের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও মাঠের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

আরও খবর: জাতীয়