জাতীয়

গভীর রাতে রাস্তায় সুমনকে কুপিয়ে হত্যা, আবারও দুঃখের সাগরে স্ত্রী

  নীলাকাশ টুডেঃ ২০ মার্চ ২০২৩ , ১:৩২:৪১ প্রিন্ট সংস্করণ

 

ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে বিয়ের এক সপ্তাহ না যেতেই কাজের জন্য ভোলায় স্ত্রীকে রেখে ঢাকায় এসেছিলেন সুমন চন্দ্র পাল। কাজ করছিলেন গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয়। কাজ শেষে মধ্যরাতে বাড্ডায় মেসে ফেরার সময় স্ত্রীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। এর মধ্যে হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে ‘ও প্রতিমা, আমাকে বাঁচাও’ বলে সুমনের চিৎকার শুনতে পান প্রতিমা রানি পাল। এরপর আর কোনো কথা শুনতে পাননি। ঘণ্টাখানেক পরে আবার ফোন দিয়ে স্বামীর গুরুতর জখম হওয়ার খবর পান তিনি।

এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ দিন স্বামীর শয্যাপাশে থেকে সেবাশ্রূশুষা করেন প্রতিমা রানি। কিন্তু স্বামীকে আর বাঁচাতে পারেননি। ছোট বেলায় মা হারানো প্রতিমা বেড়ে ওঠেন নানির কাছে। বিয়ে করে যখন জীবনে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন, তার ২৮ দিনের মধ্যেই সেই স্বপ্নভঙ্গ ঘটে। জীবনে টিকে থাকার অবলম্বন হারানো প্রতিমা এবার চেষ্টা করেন স্বামীর ঘাতকদের শাস্তি নিশ্চিতের জন্য। ঘটনার এক মাস পর ৪ মার্চ আবার ঢাকায় এসে বাড্ডা থানায় মামলা করেছেন তিনি। কিন্তু এখনো এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

এ নিয়ে হতাশ প্রতিমা রানি বলেন, ‘কে আমার সুমনকে খুন করল, তা আমি জানতে চাই।’

 

এ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সুমন হত্যাকাণ্ডটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা কোনো ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়নি। তাঁকে কুপিয়ে জখমের পরের ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁকে কারা খুন করেছে, সেটি আমরা এখনো চিহ্নিত করতে পারিনি।’

আর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বেলাল হোসেন বলেন, সুমনের সঙ্গে তাঁর কাজের জায়গায় কারও বিরোধ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, হামলাকারীরা সুমনের মুঠোফোন বা মানিব্যাগ নেয়নি। তবে অন্য কোনো কিছু খোয়া গেছে কি না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।

প্রতিমা রানি জানান, ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। নানির কাছে বড় হয়েছেন। তাই লেখাপড়া বেশি করতে পারেননি। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তাঁদের বাড়ি ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার গোলকপুর গ্রামে। মাস ছয়েক আগে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে পাশের গ্রামের সুমনের সঙ্গে পরিচয় হয়। কয়েক মাসের জানাশোনা শেষে গত ১৭ জানুয়ারি পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়। এক সপ্তাহ পরেই সুমন কাজের জন্য ঢাকায় চলে আসেন।

কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই সুমন তাঁকে ফোন করতেন। কাজ শেষে অন্যান্য দিনের মতো গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে বাড্ডার প্রগতি সরণির ফুটপাত দিয়ে হেঁটে মেসে ফিরছিলেন সুমন। মুঠোফোনে কথা বলছিলেন প্রতিমার সঙ্গে। হঠাৎ করে ‘ও প্রতিমা’ বলে চিৎকার দেন সুমন।

প্রতিমা জানান, এরপর মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। তবে সুমন আর কোনো কথা বলেননি। প্রতিমা কেবল পাগলের মতো ‘ও সুমন, ও সুমন’ বলে চিৎকার দিতে থাকেন। সুমনের কোনো সাড়া না পেয়ে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন প্রতিমা। পরে আবার রাত ২টা ১৫ মিনিটে কল দেন সুমনের মুঠোফোনে। তখন অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোন ধরে প্রতিমাকে বলেন, সুমনকে কে বা কারা ছুরি দিয়ে গুরুতর জখম করেছে। তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরদিন ঢাকায় চলে আসেন প্রতিমা।

 

এরপর ১১ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি সুমন মারা যান। সেই স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘আমার পোড়া কপাল। অনেক কষ্টে বড় হলাম। পেলাম ভালো একজন জীবনসঙ্গী, যে আমার দুঃখ বুঝত। কিন্তু সে আমার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য নাই হয়ে গেল।’

প্রতিমা জানান, বিয়ের পর সুমন বহুবার মুঠোফোনে তাঁকে বলেছিলেন ঢাকায় সংসারের যে ব্যয়, সেটা তিনি জোগাড় করতে পারবেন না। রেস্তোরাঁয় কাজ করে যে টাকা পান, তা দিয়ে নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ মেটানো সম্ভব। কিন্তু প্রতিমাকে ঢাকায় নিয়ে এসে বাসা ভাড়া করে সংসার পাতা কোনোভাবে সম্ভব নয়। তাই সুমন প্রতিমাকে বলেছিলেন, দুই–তিন মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ভোলায় চলে যাবেন। সেখানেই বাসা ভাড়া নিয়ে প্রতিমার সঙ্গে সংসার শুরু করবেন।

প্রতিমা রানি জানান, গুরুতর জখমের পর সুমন অনেক কষ্টে কথা বলতেন। তবে কে বা কারা সেদিন তাঁকে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তিনি জানান, সুমনকে যেখানে কুপিয়ে জখম করা হয়, সেই জায়গায় আলো ছিল না। অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা। সুমন বারবারই বলেছিলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগে দুই যুবক তাঁকে ছুরি মেরে পালিয়ে যান।

প্রতিমা বললেন, ‘যে ১১টা দিন আমি সুমনের পাশে ছিলাম, তা এই জীবনে কোনো দিন ভুলতে পারব না। যখন সুমন মারা গেল, তখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আমার এক আত্মীয় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন, সুমনের চোখ স্থির হয়ে গেছে। তখন আমি উঠে ডাকলাম, ও সুমন, ও সুমন…। তখন বুকে মাথা রেখে বুঝলাম; সুমনের দেহঘড়ি থেমে গেছে। তখন মনে হলো, আমার জীবনে আবার দুঃখের ঘণ্টা বেজে উঠল।’

আরও খবর: জাতীয়