এক অফিসেই দিনে ঘুস ১০ লাখ টাকা


MD Nuruzzaman প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ৯, ২০২৩, ৩:২৫ পূর্বাহ্ন /
এক অফিসেই দিনে ঘুস ১০ লাখ টাকা

নীলাকাশ টুডেঃ

ছকে বাঁধা দুর্নীতির চরকি ঘুরছে পাসপোর্ট অফিসে। যেন লাগাম টানার কেউ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ একদিকে কড়াকড়ি করলে আরেক দিকে খুলে দেওয়া হয় ঘুসের নতুন পথ। এভাবে বেশিরভাগ পাসপোর্ট অফিসে রমারমা ঘুস বাণিজ্য এখনো বহাল। কথিত ‘চ্যানেল মাস্টারের’ মাধ্যমে অধিকাংশ পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন পাসপোর্ট প্রতি ঘুস তোলা হয়। যার যোগফল কয়েক কোটি টাকা। কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুস ওঠে হাতে হাতে। ঘুসের সদর দপ্তর হিসাবে পরিচিত কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে দিনেই ঘুস ওঠে কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা। সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব বিষয়ে ওঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। তবে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের হাত অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

সরেজমিন কুমিল্লাঃ ১৮ ডিসেম্বর সকাল ১০টা। কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে হাজির হয় যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম। সপ্তাহের প্রথম কর্ম দিবস। তাই লোকে-লোকারণ্য অফিস চত্বর। প্রধান ফটক থেকে সেবাপ্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন। লাইনটি কয়েক প্যাঁচ ঘুরে গিয়ে ঠেকেছে ভবনের বারান্দায়। দুটি কাউন্টারে আবেদন জমার কাজ চলছে। বিশেষ কিছু চিহ্ন পরীক্ষা করে একে একে আবেদন ফরম জমা নিচ্ছেন দুজন কর্মচারী। তবে চিহ্ন না থাকলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীকে। এমনকি অনেককে লাইনের বাইরে বের করে দিচ্ছেন আনসার সদস্যরা। অপেক্ষমাণ কয়েকজনের আবেদন হাতে নিয়ে দেখা যায়, একেকজনের ফরমে একেক ধরনের সাংকেতিক সিল। যেমন ‘ঠিকানা’, এজে ২৩, এ+ ইত্যাদি। এগুলো হলো নির্ধারিত ঘুসের মাধ্যমে পাসপোর্ট দেওয়ার বিশেষ পদ্ধতি।

এসব সাংকেতিক চিহ্নযুক্ত সিলের রহস্য ভেদ করতে ১৯ ডিসেম্বর দালাল চক্রের ডেরায় হাজির হন প্রতিবেদক। তখন সকাল ৯টা। কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও। ডায়াবেটিক হাসপাতাল ছেড়ে কিছুদূর এগোতেই নিসা টাওয়ার। এর গলিতে দিনভর পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ভিড়। এখানে দোকান খুলেছেন শহরের শীর্ষস্থানীয় পাসপোর্ট দালাল জাকির হোসেন ওরফে কাজল। দোকানের নাম ন্যাশনাল ট্রেডার্স। ২টি কক্ষ নিয়ে অফিস। টেবিলের একদিকে পাসপোর্ট আবেদনের স্তূপ, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি। কম্পিউটারে ফরম পূরণের সিরিয়াল দিয়ে বসে আছেন অনেকে। তাদের কেউ কেউ প্রয়োজনীয় লেনদেনও সেরে নিচ্ছেন। বেশ কয়েকটি আবেদন ফরমের পেছন পাতায় বিশেষ চিহ্নযুক্ত সিল দিচ্ছেন একজন কর্মচারী। এ সময় পাসপোর্ট প্রত্যাশী সেজে কাজলের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। কাজল বলেন, ‘এখানে ফরম পূরণ করা হয়। চার্জ ২০০ টাকা। তবে কেউ ‘চ্যানেলে’ জমা করতে চাইলে টাকা লাগবে দেড় হাজার।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, এখানে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ভিড়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে-কাজল প্রভাবশালী দালাল। তার সঙ্গে কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সখ্য আছে। বিশেষ করে উপ-পরিচালক নূরুল হুদার সঙ্গে তার দহরম-মহরম ওপেন সিক্রেট। এমনকি অফিসের সরকারি গাড়িতেও ঘোরাফেরা করেন কাজল। এছাড়া শহরের অন্যতম প্রভাবশালী দালাল শাহজাহান ও তার ভাই ছোটন, নোয়াপাড়ার ইকবাল, মিজান, পল্লব, মিনহাজ, কাশেম, শাহজাহানের ছেলে সজল ও আসিফ, ইসমাইল ওরফে ভাগিনা ইসমাইল (মহিউদ্দিন এন্টারপ্রাইজ) এবং আনোয়ারকে অফিস চত্বরেই সার্বক্ষণিক দেখা যায়। নূরুল হুদা মাঝেমধ্যে দালাল কাজলকে নিয়ে শহরের বিশেষ একটি হোটেলে সকালের নাস্তা খেতেও আসেন। এত ঘনিষ্ঠতার কারণ জানতে চাইলে কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনি আমার আত্মীয়।’ নূরুল হুদা নিজের অপরাধ আড়াল করতে কাজলের মাধ্যমে সমাজের অনেককে ম্যানেজ করেন।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরে কুমিল্লায় ই-পাসপোর্টের আবেদন জমা হয় ২১ হাজার ১৫৫টি। দৈনিক গড়ে এক হাজার ৩০০টির বেশি। এর ৯০ শতাংশ আসে দালাল চ্যানেলে। আবেদনপ্রতি নির্ধারিত ঘুসের রেট ১২শ টাকা। ফলে দৈনিক ঘুসের অঙ্ক দশ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। মাসের হিসাবে ২ কোটি টাকা। এখান থেকে ৭০ শতাংশ টাকা নূরুল হুদা নিজের পকেটে রাখেন। বাকি ৩০ শতাংশ অফিসের অন্যান্য স্টাফদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়।

সূত্র বলছে, দেশের অন্তত ৩০টি পাসপোর্ট অফিসে এ ধরনের বিশেষ ঘুস চ্যানেল চালু রয়েছে। সেখানেও কাজলের মতো বহু প্রভাবশালী দালাল রয়েছে। অফিস ভেদে চ্যানেলে ঘুস ১২শ থেকে দেড় হাজার টাকা। কুমিল্লা ছাড়াও চট্টগ্রাম বিভাগীয় অফিস, মুনসুরাবাদ, সিলেট বিভাগীয় অফিস, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী, রাজশাহী, হবিগঞ্জ, গাজীপুর, নেত্রকোনা, নরসিংদী, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সাতক্ষীরা এবং ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় চালু আছে ঘুস চ্যানেল। সূত্র যুগান্তর

এদিকে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানু রোববার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে বিধি অনুযায়ী তদন্ত করা হয়। চাকরি বিধিতে যে শাস্তির কথা বলা আছে তার বাইরে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘুস চ্যানেল বা এ ধরনের দুর্নীতি ফের শুরু হয়েছে বলে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে যদি এটা কেউ করে বা দুঃসাহস দেখায় তবে ছাড় দেওয়া হবে না। বর্তমান মহাপরিচালক এক্ষেত্রে কঠোর। বর্তমানে দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না এটা আমরা বলতে পারি।