সারাদেশ

নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর আপনের সলিল সমাধি

  প্রতিনিধি ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৬:০২:১২ প্রিন্ট সংস্করণ

নীলাকাশ টুডে

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন ইমরুল কায়েস আপন। নতুন জীবনের স্বপ্নে বিভোর এই তরুণ ১১ লাখ টাকা খরচ করে ইউরোপে প্রবেশের জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন সমুদ্রপথে। তবে তাঁর সেই স্বপ্নের সলিল সমাধি হয়েছে সাগরে। তিউনিসিয়ায় নৌকাডুবিতে যেসব বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, এই যুবক তাদেরই একজন। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গঙ্গারামপুর গোহালা ইউনিয়নের গয়লাকান্দি গ্রামে।

আপনের মৃত্যুর খবরটি দেওয়া হয়নি তাঁর পিতা পান্নু শেখকে। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত এ বাবা। তিনি বলেন, ‘শুনেছি ছেলে বেঁচে আছে। কেউ বলছে হাসপাতালে, কেউ বলছে জেলে। আমি শুধু আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই। ছেলেকে ফিরে পেলে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’ একমাত্র ছেলের জন্য হা-হুতাশ করছেন তিনি। আপনের মা কেয়া কামরুন নাহার ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন। কিন্তু অসুস্থ স্বামীকে খবরটি জানাননি। ছেলের শোকে পাথর তিনি।

১৫ বছর সৌদি আরবে থাকা পান্নু শেখ বছরখানেক আগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন, হারান কর্মক্ষমতা। বন্ধ হয় আয়ের পথ। তাই সিদ্ধান্ত নেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে ইতালি পাঠানোর। পান্নু শেখ বলেন, ‘গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরসহ আশপাশের অনেকেই ইতালি যায়। তাদের সঙ্গে ছেলেকে পাঠিয়েছি। তাকে পাঠিয়ে এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি।’
তিনি আরও বলেন, গত ৮ জানুয়ারি এক্সিম ব্যাংকের টেকেরহাট শাখার মাধ্যমে দালাল রহিমের কাছে ১১ লাখ টাকা পাঠাই। রহিম লিবিয়া থাকে। তার বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাগদী ইউনিয়নের গজনা গ্রামে। জীবনের সঞ্চিত সব সম্বল দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। এখন কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

মাদারীপুরের পাঁচ যুবকের মৃত্যু

অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পাঁচ যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ নয়ন বিশ্বাস বেঁচে আছে দাবি পরিবারের। গত শুক্রবার দুই যুবকের মৃত্যুর খবর পেয়ে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। এর তিন দিন পর মঙ্গলবার আরও দু’জনের মৃতুর খবর পেয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়েন স্বজনরা। আদরের সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা তাদের পরিবার। এই ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। একই সঙ্গে সরকারের কাছে তাদের দাবি দ্রুত লাশ ফেরত আনা।

নিহতদের বাড়ি গিয়ে জানা গেছে, দুই মাস আগে পাঁচ যুবক ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। গত বুধবার লিবিয়া থেকে ইঞ্জিনচালিত একটি ছোট নৌকায় গেম (সাগরপাড়ি) দেন তারা। ৩২ জন ধারণক্ষমতার নৌকায় ৫২ জনকে নিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে নৌকার ইঞ্জিন ফেটে যায়। ইতালি পৌঁছে দেওয়ার জন্য দালালরা ১১ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছে।

রাজৈর থানার ওসি আসাদুজ্জামান হাওলাদার আসাদ জানান, এ ব্যাপারে এখনও কেউ অভিযোগ করেননি। নিহতদের পরিবার থেকে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. মারুফুর রশীদ খান বলেন, পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনা শুনেছি। তবে এখনও কোনো চিঠি পাইনি। লাশ দেশে আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নিহত ৯ জনের মধ্যে ৮ জনই বাংলাদেশি

লিবিয়া থেকে নৌকায় করে সাগরপথে ইউরোপ যাওয়ার পথে তিউনিসীয় উপকূলে নৌকাডুবে নিহত ৯ জনের মধ্যে আটজনই বাংলাদেশি। অন্য ব্যক্তি পাকিস্তানের নাগরিক। এ সময় ২৭ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তারা অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। তাদের পরিচয় পেলেও মরদেহের সন্ধান মেলেনি।
নিহতরা হলেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার শেনদিয়া গ্রামের সজল, একই উপজেলার  কদমবাড়ি উত্তরপাড়ার নয়ন বিশ্বাস, সরমঙ্গল গ্রামের মামুন সেখ, তেলিকান্দি গ্রামের কাজি সজীব ও কেশরদিয়া গ্রামের কায়সার। বাকিরা হলেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের রিফাত, ফতেহপট্টি গ্রামের রাসেল ও গয়লাকান্দি গ্রামের ইমরুল কায়েস আপন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি অভিবাসী দল নৌকায় রাতে লিবিয়ার জুয়ারা উপকূল থেকে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। মধ্যরাতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। নৌকায় ৫২ জন যাত্রী এবং চালক ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান আফ্রিকা অনুবিভাগের মহাপ‌রিচালক এ এফ এম জাহিদ-উল-ইসলাম।

দুর্ঘটনার পর ৫৩ জনের মধ্যে ৪৪ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশি। বাকিদের মধ্যে পাকিস্তানের আটজন, সিরিয়ার পাঁচজন, মিসরের তিনজন এবং নৌকার চালক রয়েছেন। নৌকাচালক মিসরীয় নাগরিক।

এ ছাড়া মুমূর্ষু অবস্থায় জীবিত উদ্ধার মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রাম ইউনিয়নের মনতোষ সরকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। উদ্ধার করা বাংলাদেশিদের মধ্যে পাসপোর্টবিহীন রয়েছেন সাতজন।

তিউনিসিয়া উপকূলে নৌদুর্ঘটনায় উদ্ধারকৃত বাংলাদেশিদের সার্বিক কল্যাণ ও মৃত্যুবরণকারীদের তথ্য নিশ্চিত করতে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি প্রতিনিধি দল তিউনিসিয়ার জারজিস শহরে অবস্থান করছে। নিহত বাংলাদেশিদের বিস্তারিত তথ্য নিশ্চিত এবং স্থানীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাদের মৃতদেহ দেশে পাঠানোর জন্য কাজ করছে দূতাবাস।

 

আরও খবর: সারাদেশ