সাতক্ষীরার পল্লীতে আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর মিছিল!


MD Nuruzzaman প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৫, ২০২২, ৮:৪৭ পূর্বাহ্ন /
সাতক্ষীরার পল্লীতে আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর মিছিল!

 

নীলাকাশ টুডেঃ সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় সুপেয় পানির অভাবে গত ২০ বছরে পানিবাহিত রোগ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে এক গ্রামের অন্তত ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর্সেনিকের নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণকাটি গ্রামের বাসিন্দারা। দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম আর্সেনিক শনাক্ত হয়েছিল এই গ্রামে।

জানা গেছে, প্রতি বছর কৃষ্ণকাটি গ্রামের অনেকে আর্সেনিকে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার অভাবে অনেকে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আর্সেনিকের ব্যাধি বয়ে বেড়াচ্ছেন। শরীরে আর্সেনিকের উপসর্গ দেখা দেওয়ায় নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছে এখানকার মানুষ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুটিগুটি ক্ষত সৃষ্টি হওয়ায় রোদে গিয়ে পরিশ্রম করতে পারেন না এলাকার পুরুষেরা।

আর্সেনিক আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে বা হাতের তালুতে বাদামি ছাপ পড়ে। সাধারণত বুকে, পিঠে কিংবা বাহুতে ‘পিগমেনটেশন’ দেখা দেয়। যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপ নেয়। সাদা এবং কালো দাগের পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তির জিহ্বা, মাড়ি, ঠোঁট ইত্যাদিতে মিউকাস ব্রন মেলানোসিসও দেখা দেয়। কারও কারও হাতের চামড়া পুরু হয়ে যায়, আঙুল বেঁকে যায়, অসাড় হয়ে যায়। এছাড়া পায়ের আঙুলের মাথায়ও পচন ধরে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার অন্যান্য লক্ষণগুলো হচ্ছে- হজমে বিঘ্ন ঘটা, পেটব্যথা, খাবারে অরুচি, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া ইত্যাদি।

সংশ্লিষ্ট এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে এসব লক্ষণে আক্রান্ত অনেকের দেখা পাওয়া গেছে। তবে তাদের ধারণা- আর্সেনিকের সঠিক কোনো চিকিৎসা নেই। তাই দীর্ঘ বছর ধরে ব্যাধি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

কৃষ্ণকাটি গ্রামের একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল সাতজন। তবে গত ১৪ বছরের ব্যবধানে সেই পরিবারের ছয়জন সদস্য মারা গেছেন আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে। কৃষ্ণকাটি গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে কেউ না কেউ আর্সেনিকে আক্রান্ত।

এদিকে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও বিভিন্ন এনজিও থেকে সুপেয় পানির প্ল্যান্ট করা হলেও সেগুলো দীর্ঘ বছর যাবত অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে তারা প্রতিনিয়ত আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করছেন। এই এলাকায় গভীর নলকূপ থাকলেও আর্সেনিক মুক্ত পানি পাওয়াটা বেশ দুষ্কর। সরকারি ভাবে পানি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটার বাস্তবায়ন হয়নি। তাই এক প্রকার নিরুপায় হয়ে আর্সেনিক যুক্ত পানি পান করছেন তারা। সংশ্লিষ্ট এলাকার শিশুরাও আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে।

এদিকে জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ওয়াটার প্ল্যান্ট বসানো হলেও সেটা দীর্ঘদিন যাবত অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর দুই বার টিউবওয়েলের আর্সেনিক পরীক্ষা করার কথা থাকলেও জনস্বাস্থ্য বিভাগ তা করে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

স্থানীয় বাসিন্দা রুমানা বেগম জানান, সর্বপ্রথম তার পরিবারে আর্সেনিক শনাক্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে তার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের সাতজন সদস্য মারা গেছেন। সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন। কখন নিজে আর্সেনিকে আক্রান্ত হবেন, সেই শঙ্কায় রয়েছেন।

তিনি জানান, একই পরিবার থেকে এতগুলো মানুষ আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি। এলাকায় সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বাধ্য হয়ে প্রতিনিয়ত তারা পানি নামক বিষ গ্রহণ করছেন। যার ফলশ্রুতিতে প্রতি বছরই এই গ্রামের অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জাকির মোড়ল জানান, তার সমস্ত শরীরে আর্সেনিক আছে। তবে কোনো ওষুধ খেয়ে এটা থেকে মুক্তি মেলেনি কারও। তার বাবা-দাদারাও আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। টিউবওয়েলে আর্সেনিক পরীক্ষা করে লাল রং দিয়ে সনাক্ত করে গেলেও বাধ্য হয়ে সেই পানি গ্রহণ করতে হচ্ছে। কারণ কোনো উপায় নেই আর। তাছাড়া সরকারও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এ বিষয়ে।

রুহুল আমীন নামে অপর ব্যক্তি জানান, বর্তমানে এই গ্রামে ৫০টি পরিবারের আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী রয়েছে। তিনি নিজেও একজন আর্সেনিক রোগী। রোদে গিয়ে পরিশ্রম করতে পারেন না, কারণ শরীরের ভেতর জ্বালাপোড়া করে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা হলে এই সমস্যার সমাধান হবে।

ফাতেমা বেগম নামে এক নারী জানান, জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করে আর্সেনিক পাওয়ায় লাল রং দিয়ে শনাক্ত করে গেছে। তারপরেও সেই পানি পান করতে হচ্ছে পরিবারের সবাইকে। কারণ বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে। তার শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের তিনজন বর্তমানে আর্সেনিক আক্রান্ত। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ভয়ে আছেন।

জমির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি আর্সেনিকে আক্রান্ত, তার সমস্ত শরীরে গুটিগুটি নানা ধরনের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। যেটিতে রোদ বা পানি লাগলে জ্বালাপোড়া করে। তার বাবা দাদারাও আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাছাড়া গ্রামের অনেক লোক মারা গেছেন আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এটা রোধে কোনো ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে কিছু বছর পরে হয়তো এই গ্রামটি জনশূন্য হয়ে পড়বে।

নাজমা বেগম নামে এক রোগী জানান, আর্সেনিকে তার স্বামী, ছেলে, দেবর ও শ্বশুর মারা গেছে। দীর্ঘ ২২ বছর নিজেও আর্সেনিক বয়ে বেড়াচ্ছেন। ঢাকায় গিয়ে কেমোথেরাপি দিতে হয়। তবে টাকার অভাবে বহুদিন ঢাকায় যাওয়া হয়নি, চিকিৎসাও করানো হয়নি। ডাক্তার আমাকে শাক-সবজি ও ফল খেতে বলেছে। শাকসবজি এলাকায় পাওয়া গেলেও ফল কিনে খেতে হয়। তাই ফল খাওয়া হয় না।

জালালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিদুল হক লিঠু জানান, তার ইউনিয়নে কৃষ্ণকাটি গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটা গ্রামে আর্সেনিকের ভয়াবহতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এখানে একই পরিবারের চারজন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এই গ্রামগুলোর অধিকাংশ মানুষের শরীরে কালো কালো নানান ধরনের চিহ্ন দেখা দেয়। এটার নাম হলো আর্সেনিক। আর্সেনিক প্রতিকার করার মতো কোনো চিকিৎসা নেই। তাই বাধ্য হয়ে তারা এই ব্যাধি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। সাধারণত বিশুদ্ধ পানির অভাবে আর্সেনিকের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে নানান ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়, এই ক্ষত একটি পর্যায়ে ক্যান্সারে রূপ নেয়। পরবর্তীতে সেই মানুষটি মারা যায়।

তিনি আরও জানান, ইতোপূর্বে অনেকবার বিভিন্ন ওয়াটার প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়েছে। তবে সেটাতে আর্সেনিক নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। যদি আর্সেনিকমুক্ত কোনো ওয়াটার প্ল্যান্ট তৈরি করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে এই ইউনিয়নের মানুষ আর্সেনিকের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে পারে।

তালা উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপ-প্রকৌশলী মফিজুর রহমান জানান, সংশ্লিষ্ট এলাকায় অতি দ্রুত পুনরায় আর্সেনিক পরীক্ষা করা হবে। ওই এলাকায় কয়েকটি ওয়াটার প্ল্যান্ট করা থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশ অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এ বিষয়টি নিয়ে দ্রুত কাজ করা হবে। ওয়াটার প্ল্যান্টগুলো চালু করে তাদের সুপ্রিয় পানির ব্যবস্থা করা হবে।

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন সাফায়াত জানান, আর্সেনিক আক্রান্তদের খুব বেশি ভালো কোনো চিকিৎসা নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু মেডিসিন তাদের জন্য সাজেস্ট করা হয়। এতে করে আর্সেনিকের প্রবলতা কিছুটা কমে থাকে, তবে সেটা নির্মূল হয় না। এ জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হল প্রথম থেকে আর্সেনিকযুক্ত পানি না খাওয়া, বিশুদ্ধ পানি পান করা। যারা আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছে তাদের নিয়মিত নিকটস্থ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। তাছাড়া যে পানিটা আমরা পান করি, সেটা বছরে দুই বার শীতের সময় ও বৃষ্টির সময় আর্সেনিক পরীক্ষা করতে হবে। প্রথমদিকে এটা নিয়ে বেশ জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা হয়েছে এবং বিনামূল্যে পানির আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছে।