লিবিয়ায় ভয়ঙ্কর বাংলাদেশি ‘মাফিয়া’ শরীফ


MD Nuruzzaman প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ৮, ২০২৩, ২:২৩ পূর্বাহ্ন /
লিবিয়ায় ভয়ঙ্কর বাংলাদেশি ‘মাফিয়া’ শরীফ

নীলাকাশ টুডেঃ
গত কয়েক বছরে ভূমধ্য সাগর পাড়ের গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ লিবিয়া বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে ইউরোপে যাওয়ার একটি রুট হয়ে উঠেছে। এই সুযোগেই কিছু বাংলাদেশি সেখানকার অপরাধী চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের এক ব্যবসা খুলে বসেছেন।

ঢাকার পুলিশ বলছে, বাংলাদেশের কুমিল্লার ছেলে ৩৭ বছর বয়সী শরীফ হোসেন লিবিয়ায় যাওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে ভয়ঙ্কর হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন, বনে গেছেন ‘মাফিয়া শরীফ’।

জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪ মাসে ভূমধ্যসাগর হয়ে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫০৮ জন ইউরোপে ঢুকেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢুকেছে তিউনিসিয়ার ৩৩ হাজার ১১৮ জন, এরপরে লিবিয়ার ২৮ হাজার ৮৭১ জন। ভূমধ্য সাগর পাড়ের এই দুই দেশের পরেই বাংলাদেশিদের অবস্থান।

এই ২৪ মাসে ২২ হাজার ১০৫ জন বাংলাদেশি সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গেছে। এদের বেশিরভাগেরই গন্তব্য ইতালি। এভাবে ইউরোপ যেতে গিয়ে শুধু ২০২২ সালেই ১৯৪০ জন মানুষ হয় মারা গেছেন নইলে নিখোঁজ হয়েছেন।

বৈশ্বিক অপরাধ পর্যবেক্ষণের প্ল্যাটফর্ম ‘গ্লোবাল অর্গানাইজড ক্রাইম ইনডেক্স’র প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়ায় মানব পাচারের ঘটনা গত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে। লিবিয়ার পুরো ভূখণ্ডের উপর সরকারের সামান্যই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং অভিবাসী পাচারের ঘটনাগুলো থেকে রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা লাভবান হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নানা

ঢাকার পুলিশ বলছে, এই পরিস্থিতিতে লিবিয়া মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধের অবাধ সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে। সেখানে বৈধ বা অবৈধ যে কোনো ধরনের অভিবাসীই যে কোনো সময় বিপদে পড়ে যেতে পারেন। দেশটির পুলিশ বা বড় মিলিশিয়া গ্রুপগুলো এই ধরনের ইউরোপগামী অভিবাসন প্রত্যাশীদের আটক বা গ্রেপ্তার করে পরে আবার মাফিয়া বা দালালদের কাছে বেচে দেন। মাফিয়াদের রয়েছে ‘গেম ঘর’। এই ঘরগুলোতে একসঙ্গে বহু মানুষকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। বাংলাদেশের শরিফ, মনির, আব্দুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন সেখানে ‘মাফিয়া’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর মধ্যে শরীফের চক্রটি সবচেয়ে বড় আর নৃশংসতায়ও শরীফ অন্যদের হার মানায়।

সম্প্রতি আব্দুল্লাহসহ কয়েকজন শরীফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন বলেও পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের মানব পাচার প্রতিরোধ দলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, শ্রমিক হিসেবে লিবিয়া গিয়ে সেখানে ‘মাফিয়া’ বনে যান অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন শরীফ। তার ‘সিন্ডিকেটে’ যুক্ত করে নেন আরও কিছু বাংলাদেশিকে। যেসব বাংলাদেশি লিবিয়ায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে হয়ত মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা উপার্জন করছে, তারা শরীফের দলে ভিড়ে গিয়ে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত কামাই করছেন।

সারা দেশে শরীফের বেশ কিছু দালাল তৈরি হওয়ার কথাও বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। এই দালালদের মাধ্যমে ইতালিতে নেওয়ার কথা বলে দুবাই বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ হয়ে তাদের নেওয়া হয় লিবিয়ায়। লিবিয়ার বেনগাজি ও উপকূলীয় শহর জুয়ারায় রয়েছে শরীফের ‘গেম ঘর’। দেশের দালালেরা ২ থেকে ৩ লাখ বা ইতালি যাওয়ার পর টাকা দেওয়ার চুক্তিতে তাদের লিবিয়া নিয়ে যায়। লিবিয়ায় শরীফের ‘গেম ঘরে’ রেখে তাদের উপর চলে নির্যাতন। এসব নির্যাতনের অসংখ্য ভিডিও ছড়িয়ে রয়েছে সোশাল মিডিয়ায়।

লিবিয়ায় নিয়মিত সরকারের পাশাপাশি অনেক এলাকাই বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘খলিফা হাফতার’ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। ইউরোপে অনিয়মিত অভিবাসন প্রত্যাশীদের ভিড় লিবিয়ায় লেগেই থাকে। সেখানকার পুলিশও অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেপ্তারে তৎপর। তবে এসব অভিবাসীদের গ্রেপ্তারের পর পুলিশ শরীফের মতো মাফিয়াদের কাছে বেচে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দরদামে গরমিল হলে বা কোনো বিপদ আঁচ করতে পারলে দালালেরাও অনেকসময় মাফিয়াদের কাছে এইসব অভিবাসন প্রত্যাশীদের ‘বেচে’ দেয়।

পুলিশের তথ্য বলছে, লিবিয়ার পুলিশ বা মিলিশিয়াদের কাছ থেকে ওইসব অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের দুই থেকে তিন লাখ বাংলাদেশি টাকায় কিনে নিয়ে শরীফ তার ‘গেম ঘরে’ নিয়ে যায়। এরপর তাদের পরিবারের কাছে সাত থেকে ১০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। অন্যান্য দালালেরাও শরীফের কাছে এসব অভিবাসন প্রত্যাশীদের তুলে দেয়।

পাসপোর্ট অনুযায়ী শরীফের বাড়ি কুমিল্লায়। সম্প্রতি দেশে একটি মামলা হওয়ার পর শরীফের নাম সামনে আসে। পুলিশের নড়াচড়া শুরু হলে গত ৩০ নভেম্বর তার প্রথম স্ত্রী হালিমা বেগম ও দ্বিতীয় স্ত্রী জাহানারা রিক্তা একসঙ্গে দেশ ছাড়েন। পরবর্তীকালে লিবিয়ায় তার বড় স্ত্রীর মৃত্যু হয় বলেও খবর রয়েছে।

এডিসি তৌহিদুল বলছেন, লিবিয়ায় এতদিন শরীফ যাদের জিম্মি করতেন, তাদের পরিবারের কাছ থেকে দেশে মুক্তিপণ আদায়ের মূল কাজটি করতেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী রিক্তা। এছাড়া শরীফের পরিবারের আরও কয়েকজন এই কাজে যুক্ত।

পুলিশের ভাষ্যমতে, লিবিয়ায় শরীফের ‘গেম ঘরে’ গড়ে এক থেকে দেড়শ বাংলাদেশি বন্দি থাকেন। তাদের একেক জনের কাছ থেকে সাত থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করে শরীফের বাহিনী। অর্থ না পেলে চলে নির্যাতন।

পাবেল আহমেদ নামে মাদারীপুরের এক তরুণ বলছেন, তার মামা ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়া যাওয়ার পর সেখানে তাকে ‘মাফিয়া শরীফ’ ধরেছেন। এখন পর্যন্ত শরীফকে ১১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার মামাকে ছাড়ছে না। এর বাইরে লিবিয়া পর্যন্ত নিতে দেশের দালাল নিয়েছে আরও ১০ লাখ টাকা।

লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে পাঁচ মাস জিম্মি হয়ে ছিলেন মাদারীপুরের রাকিবুল। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের দালাল তাকে লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার পর দুই দফায় ১১ লাখ টাকা নিয়ে একটি নৌকায় তুলে দেয়। সেই নৌকাসমেত লোকজনকে ধরে নিয়ে যায় মাফিয়ারা। মাফিয়াদের হাতে পাঁচ মাস বন্দি থাকার পর ২০২২ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশি দূতাবাসের সহায়তায় মুক্তি পান তারা।

রাকিবুলের বর্ণনা মতে, মাফিয়ারা তাদের প্রায় ৬০ জনকে যে ঘরে আটকে রেখেছিল সেটি সর্বোচ্চ ১০ জন থাকার মতো। সারাদিনে একটা খুবজ বা রুটি দিয়ে দরজা আটকে চলে যেত তারা। পানি এমনভাবে দিত যে একেকজনকে এক ছিপি করে পানি পেত। কখনও ৪৮ ঘণ্টায়ও খাবার দিত না। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আরও হানা দেয় উকুনের যন্ত্রণা। গরমের মধ্যে দিন-রাত এভাবে বন্দি থাকলেও ঘুমাতে পারতেন না তারা। আর ছিল কথায় কথায় নির্যাতন।

২০২০ সালের ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ এলাকার একটি ‘গেম ঘরে’ ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসন প্রত্যাশীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে মাফিয়ারা। তাদের মধ্যে নিহত ১১ জনের বাড়ি মাদারীপুরে। ওই ঘটনায় দেশে বেশ কয়েকটি মামলা হয়, পুলিশ গ্রেপ্তার করে কয়েকজনকে। কিন্তু কমেনি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। এরপরেও তরুণ-যুবারা প্রাণ বিপন্ন করে হলেও ইউরোপ যেতে দালালের হাতে তুলে দিচ্ছে কষ্টার্জিত অর্থ।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরীফুল হাসান বলছেন, গত এক যুগে ৬২ হাজার বাংলাদেশি চোরাই পথে ইউরোপে গেছেন। এভাবে ইউরোপ যাত্রার ১৮টি রুট বিভিন্ন গবেষণায় চিহ্নিত করা গেছে। তার মধ্যে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রার রুটটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। ৬২ হাজারের মধ্যে ৪০ হাজার বাংলাদেশিই ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গেছেন। এভাবে যাত্রায় ঝুঁকিও কম নয়। এভাবে যেতে গিয়ে অন্তত তিন হাজার বাংলাদেশি বিগত বছরগুলোতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

শরীফুলের ভাষ্যে, গত কয়েকবছরে ইউরোপ ও লিবিয়া ফেরত প্রায় আড়াই হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। তাতে যে চিত্র পাওয়া যায় মূলত বাংলাদেশের শরীয়তপুর, মাদারীপুরসহ আশপাশের কয়েকটি জেলা, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, ভৈরব, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসব জায়গার লোকেরা এভাবে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে যাচ্ছেন বেশি। একেকজন এভাবে ইউরোপে যেতে তিন থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করছেন। এই জেলাগুলোতে এক ধরনের দালাল আছেন, যারা তরুণদের স্বপ্ন দেখান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত দালালদের সঙ্গে এদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। এছাড়া ফেইসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ও ইমোর মাধ্যমেও সরাসরি দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব।

শরীফুল বলেন, “বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পুলিশ এখন পর্যন্ত স্থানীয় দালালদের ধরতে পেরেছে। কিন্তু এরা রিপ্লেসেবল, একজন চলে গেলে আরেকজন আসে। যারা লিবিয়া, দুবাই, তুরস্ক বা তিউনিসিয়ায় বসে এসব চক্র চালাচ্ছেন, তাদের কিছু করা যাচ্ছে না।”