রাজনীতির অন্দরমহলে সরব কূটনীতি


MD Nuruzzaman প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১৫, ২০২২, ২:২৯ পূর্বাহ্ন /
রাজনীতির অন্দরমহলে সরব কূটনীতি

নীলাকাশ টুডেঃ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশি কূটনীতিকদের ভূমিকা নিয়ে রাজনীতিতে সরব আলোচনা হচ্ছে।

প্রকাশ্যে ও পর্দার আড়ালে চলছে নানা তৎপরতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিক অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সোচ্চার।

পাশাপাশি তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করছেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও বিভিন্ন ইস্যুতে বিদেশিদের দ্বারস্থ হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির ঢাকার বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকার ও বিএনপির পক্ষ থেকে লিখিতভাবে বিভিন্ন দূতাবাসকে অবহিত করা হয়।

যদিও বাংলাদেশ সরকার সংশ্লিষ্ট বিদেশি কূটনীতিকদের প্রকাশ্য তৎপরতাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে বিবেচনা করছে।

সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এসব কূটনীতিকের আচরণ কূটনীতিসংক্রান্ত ভিয়েনা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ।

কূটনীতিকদের সক্রিয় তৎপরতার মধ্যে সর্বশেষ বুধবার ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানালে বাংলাদেশ সরকারের তরফে পূর্ণ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, পিটার হাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইজিপিকে বলেছি। পাশাপাশি তাকে (পিটার হাস) বলা হয়েছে, কোথাও যাওয়ার আগে আমাদের জানালে ভালো হয়।

এদিন সকালে একটি বেসরকারি অনুষ্ঠানে যোগদানের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জরুরি ভিত্তিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

তিনি সেখানে গিয়ে তার নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বুধবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জরুরি ভিত্তিতে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জানান, তিনি তার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। সকালে একটি বাসায় প্রাইভেট অনুষ্ঠানে গেলে বাসার সামনে অনেক লোকসমাগম হয়। সেখানে সাংবাদিকরাও ছিলেন। রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে টেলিফোন করে বলেন, তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসুন। এসব লোক আপনার গাড়ি ব্লক করতে পারেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কি আপনার গাড়ি ব্লক করেছিল? সেখানে কি আমাদের পুলিশ ছিল? তারা কি আপনাকে কোনো হেনস্তা করেছে? আপনার গায়ে হাত দিয়েছে?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত আমাকে বললেন, তারা ব্লক করেনি। পুলিশ ছিল। হেনস্তাও করেনি। তবে তার গাড়িতে কোনো আঁচড় দিয়ে থাকতে পারে। আমি বললাম, পুলিশ আপনার নিরাপত্তা দেবে। আমি আপনাকে নিরাপত্তার পূর্ণ গ্যারান্টি দিচ্ছি। আমি পিটার হাসকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি প্রাইভেট অনুষ্ঠান করছেন, সেটা লোকে জানল কীভাবে? নিশ্চয়ই আয়োজকরা বলে দিয়েছেন। টিভি ক্যামেরা এলো কীভাবে? এটা জিজ্ঞাসা করেন। আমাদের দেশ স্বাধীন মতপ্রকাশে বিশ্বাসী। আমরা সাংবাদিকদের নিষেধ করতে পারব না। আপনি চাইলে, সাংবাদিকরা যাতে দূরত্ব বজায় রাখেন সেটা নিশ্চিত করতে পারব। কিন্তু সাংবাদিকদের কাভার করতে নিষেধ করতে পারব না।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এ সময় উল্লেখ করেন যে, রাষ্ট্রদূতকে দেখে তার মনে হয়েছে যে, তিনি দুশ্চিন্তার মধ্যে আছেন। আমি আইজিপিকে নিজে নির্দেশ দিয়েছি উনার পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। পুলিশ পূর্ণ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়েছে।

সূত্রমতে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বিএনপির গুম হওয়া নেতা মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোনের শাহীনবাগের বাসায় যান। সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম গুম হওয়া পরিবারের ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়ক। অন্যদিকে একই সময়ে বিএনপির সময়ে গুম হওয়া স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের কান্না’ শাহীনবাগে মানববন্ধন আয়োজন করে। ‘মায়ের কান্না’ সংগঠনের সদস্যরা পিটার হাসের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের নামে বিমানবাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য গুমের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সংগঠন হচ্ছে মায়ের কান্না।

আরও জানা গেছে, মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলামের বাসায় সংগঠনটির সদস্যরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। রাষ্ট্রদূত পিটার হাস তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিমানবাহিনীর সদস্যদের সন্তান ও চাকরিচ্যুত সদস্যরা খবর পেয়ে জমায়েত হন। সেখানে রাষ্ট্রদূতের কাছে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন সংগঠনের সদস্যরা।

মায়ের কান্না সংগঠনের সদস্যরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে ৪৫ বছর আগের গুমের ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত চান। একই সঙ্গে সামরিক শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। মায়ের কান্না সংগঠনের দাবি, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে পরবর্তী সময়ে গুমের ঘটনা বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।

সূত্রমতে, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সেখান থেকে সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত জানানো হয়নি। তবে দুপুরের পর ঢাকায় আমেরিকান সেন্টারে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র জেফ রিডেনর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সকালে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। বিষয়টি আমরা বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেছি।’ কীভাবে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল, সেই বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করেননি।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫টি দেশের কূটনীতিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বন্ধু ও অংশীদার হিসাবে এ দেশের সাফল্যকে আরও উৎসাহিত করতে আগ্রহী এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তি মূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করছি।’ এর আগে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করলে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করলেও ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়াসহ অপরাপর ‘বিগ পাওয়ার’ প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করার রেওয়াজ নেই। কিন্তু জাপানের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিকে সম্প্রতি  জানতে চাওয়া হয় যে, ভূ-রাজনীতিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন কৌশলগত জোটভুক্ত দেশ হিসাবে তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন কিনা। জবাবে ইতো নাওকি বলেছেন, তিনি তার দেশ জাপানের মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। তিনি গত নির্বাচনের চেয়ে গুণগত মানে ভালো নির্বাচন কামনা করেন। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে ১৫ রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিতে জাপানের রাষ্ট্রদূত অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকার ৭ ও ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় যা হয়েছে সে ব্যাপারে পুলিশের ভাষ্য সব বিদেশি দূতাবাসে লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছি। এ সময় মন্ত্রী উল্লেখ করেন, অস্ট্রেলিয়ায় এক নারী জলবায়ু পরিবর্তনের সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে রাস্তা বন্ধ করেছিলেন। ওই দেশ তাকে ১৫ মাসের জেল দিয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে পুলিশি হামলা ও অভিযান, দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার এবং ঢাকার সমাবেশের স্থান নিয়ে নানা টালবাহানার ঘটনা বিভিন্ন দূতাবাসকে অবহিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে নির্বাচন ও উত্তপ্ত রাজনীতি নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন সময়ে তৎপরতা চালিয়েছেন। ‘ওয়ান-ইলেভেন’র আগে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পেট্রিসিয়া বিউটেনিস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী খুবই তৎপর ছিলেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব কমাতে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেস তারানকো দেশে এসে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি একই ইস্যুতে ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশ সফর করেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সৃষ্ট সংকট নিরসনে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফান। তবে বিদেশিদের তৎপরতায় সফলতা খুব বেশি আসেনি। বাংলাদেশের রাজনীতির জট খুলেছে অভ্যন্তরীণ তৎপরতায়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, সরকার, নিরাপত্তাবাহিনী, আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার বিশেষ ভূমিকা ছিল। যদিও অনেক সময়ে নির্বাচন বর্জন করেছে রাজনৈতিক দল। সূত্র যুগান্তর