নীলাকাশ টুডেঃ রাজধানীর তাঁতীবাজার থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ভাড়া করা একটি মোটরসাইকেলে করে নিউমার্কেটে যাচ্ছিলেন স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন খান। পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সামনে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয় একদল ডাকাত। পরে ঢাকার কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে তাঁকে ফেলে দিয়ে চলে যায় ডাকাত দল।
ওই ঘটনার পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন শাহবাগ থানায় মামলা করেন। গত বুধবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে সাবেক পুলিশ সদস্য গোলাম মোস্তফা ওরফে শাহীনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকাও উদ্ধার করা হয়।
দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ডাকাতি করে গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বাধীন ডাকাত দল। চক্রের কয়েকজন সদস্য ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে লক্ষ্য ঠিক করেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যে ডাকাতি করেন চক্রের অন্য সদস্যরা।
মিশু বিশ্বাস, রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানায়, চাকরিতে থাকাকালে ছুটি নিয়ে ছিনতাই-ডাকাতি করতেন পুলিশের কনস্টেবল গোলাম মোস্তফা। ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়লে ২০০৬ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। পরে নিজেই গড়ে তোলেন ২০ সদস্যের ডাকাত দল। সপ্তাহে তাঁরা এক-দুটি ডাকাতি করতেন। তাঁদের লক্ষ্য থাকত তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী এবং হুন্ডি ও মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় বেশি ডাকাতি করতেন তাঁরা।
ডিবি কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, নিউমার্কেট এলাকায় মহিউদ্দিনের গয়নার দোকান রয়েছে। ঘটনার দিন তাঁতীবাজার এলাকা থেকে ফেরার পথে তাঁকে অনুসরণ করেন ডাকাত দলের দুই সদস্য। তাঁরা একটি মোটরসাইকেলে করে মহিউদ্দিনের পিছু নেন। ডাকাত দলের আরও পাঁচ সদস্য আগে থেকে একটি জিপ গাড়ি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নেন।
রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ডাকাতি করে গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বাধীন ডাকাত দল। চক্রের কয়েকজন সদস্য ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে লক্ষ্য ঠিক করেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যে ডাকাতি করেন চক্রের অন্য সদস্যরা। এই চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ডিবি সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ডাকাতি করত গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বাধীন ডাকাত দল। পুলিশ ও র্যাবের নজর এড়াতে তাঁরা ডাকাতির কাজে ব্যবহার করতেন সাদা রঙের একটি জিপ গাড়ি। ওই গাড়ির মালিক একজন প্রকৌশলী। সেই গাড়িতে একটি বিশেষ বাহিনীর স্টিকার লাগানো থাকত। গাড়িটিতে আরও ছিল ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড। এ ছাড়া তাঁদের কাছে থাকত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মতো ওয়াকিটকি, হাতকড়া ও জ্যাকেট। এ কারণে দিনে ডাকাতি করলেও কেউ তাঁদের সন্দেহ করত না। এভাবেই প্রায় ১৬ বছর ধরে ডাকাতি করছিলেন তাঁরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, একজন প্রকৌশলী ওই গাড়ি নিলামে কিনে ফেলে রেখেছিলেন। তাঁর এলাকার এক ছোট ভাই গাড়িটি ঠিক করে চালাতেন। মাঝেমধ্যে ওই ছোট ভাই তাঁর এক বন্ধুকে গাড়িটি ভাড়া দিতেন। সেই বন্ধুর মাধ্যমেই গাড়িটি ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত হতো।
ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন মামলায় উল্লেখ করেছিলেন, জলপাই রঙের একটি পাজেরো গাড়ি তাঁকে বহনকারী মোটরসাইকেলের পথ আটকায়। তবে জলপাই রঙের পাজেরো গাড়ি নয়, ডাকাতিতে ব্যবহার করা হয়েছে সাদা রঙের একটি জিপ গাড়ি।
এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী মহিউদ্দিন বলেন, ‘ভুলে গাড়ি জলপাই রঙের বলে মামলায় উল্লেখ করেছিলাম।’
ডাকাতির টাকায় জমি-বাড়ি
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডাকাতির টাকায় গোলাম মোস্তফা ঢাকার সাভার ও ডেমরা এলাকায় জমি কিনে টিনশেড বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন। তবে নিজে পরিবার নিয়ে থাকেন সাভারে একটি ভাড়া বাসায়। তাঁর গ্রামের বাড়ি বরগুনার আমতলী উপজেলার কলাগাছিয়া গ্রামে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ২০টির বেশি ডাকাতি, ছিনতাই ও অস্ত্রের মামলা রয়েছে।
ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গোলাম মোস্তফা বলেছেন, চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতি করে অনেকে নেশাসহ নানা অপকর্মে টাকা খরচ করেন। তবে তিনি ডাকাতির টাকায় কেনেন জমি।
ডিবি জানায়, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত গাড়িটি ভাড়া করতেন ডাকাত দলের গ্রেপ্তার হওয়া সদস্য শাহাদৎ হোসেন। তাঁর বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতির দুটি মামলা রয়েছে।
চক্রের গ্রেপ্তার আরেক সদস্যের নাম সাইদ মনির আল মাহমুদ। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানার চরশালীপুর গ্রামে। থাকেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি ভাড়া বাসায়। সেখান থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় গিয়ে এই চক্রের সঙ্গে ডাকাতি করেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের তিনটি মামলা রয়েছে।
ডিবি আরও জানায়, ডাকাত দলের গ্রেপ্তার আরেক সদস্য রুবেল ইসলামের বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের কাহারোল থানার মহেষপুরে। আরেক সদস্য জাকির হোসেনের বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন খিলগাঁও এলাকায়। তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে।